চট্টগ্রামের সময় নিউজ ডেস্ক ;
রাসেলস্ ভাইপার, চন্দ্রবোড়া কিংবা উলুবোড়া যে নামেই ডাকা হোক না কেন। তিনটি একই প্রজাতির সাপ। তবে নাম ভিন্ন। সম্প্রতি, ফেসবুক জুড়ে রাসেলস্ ভাইপার নিয়ে কিছু পোস্ট আর নানা বিবরণ নানা বিশেষজ্ঞের সমাহার নজরে পড়ার মতো ছড়িয়েছে। ফেসবুক পোস্ট বলেছে, এ সাপ নাকি দেশের ২৭ জেলায় ছড়িয়ে গেছে।
প্রকৃতপক্ষে, দেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর অন্তত কয়েক লাখ মানুষ সাপের দংশনের শিকার হতো, বছরে অন্তত ৭ হাজার মানুষ মারা যেত। কিন্তু দেশে সাপের গবেষণার পর মৃত্যুর হার অনেকটা কমতে শুরু করেছে।
দেখা গেছে, প্রতি বন্যার সময় অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই এই তিন মাস সাপের দংশন এবং তার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে সাপ এবং সাপের দংশনজনিত মৃত্যু এবং শারীরিক ও মানসিক আঘাত নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী এলাকায় সাপের কামড় এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে।
বর্তমান সময়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে রাসেলস্ ভাইপার নিয়ে। এটি সত্য দেশে যেসব সাপ দেখা যায়, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বিষাক্ত। বিভিন্ন তথ্য সূত্র বলছে, এই সাপটি কয়েক শতক ধরে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে দেশে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সাপটির দেখা মিলেনি। কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবার এই সাপে দংশনের ঘটনা ঘটার প্রমাণ দেখা যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলে এখন ধানকাটার মৌসুম চলছে। কিন্তু সে সব চরে বসবাসরত মানুষ রাসেলস্ ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপের আতঙ্কে ধানকাটা বন্ধ করে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। একের পর এক রাসেলস্ ভাইপারের দেখা মিলেছে চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়। এতে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই। তাঁরা ধারণা করছেন, এ সাপ ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে। বিশেষ করে বন্যা ও নদীর পানিতে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশে ঢুকছে। আর অতিদ্রুত এটি বংশবিস্তার করে চলছে।
এ বিষয়ে টক্সিকোলজি সোসাইটি অফ বাংলাদেশের সভাপতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও মেডিসিনে অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, ‘রাসেলস্ ভাইপার বা কোন সাপেই নিজ থেকে তেড়ে এসে দংশন করে না। কেবল উত্ত্যক্ত করলেই নিজ রক্ষার্থে দংশন করে। তেড়ে এসে দংশন করার প্রশ্নেই আসে না। চন্দ্রবোড়া সাপ যে সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিকাজে সাবধানতা অবলম্বন করুন। কর্মস্থলে সাপ আছে কিনা দেখে নিন। এরা প্রকৃতির সাথে মিশে থাকে। সম্ভব হলে পায়ে বুট পরিধান করুন। এরা দিনের বেলা খাবারের খোঁজে সচল থাকে।’
ডা. এম এ ফয়েজ আরো বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত কাউকে যদি সাপ দংশন করে। তাহলে দয়া করে গিট দেবেন না। অঙ্গটি অচল করে অতিদ্রুত উপজেলা-জেলা ও নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাবেন। চিকিৎসায় বেশির ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যান। বিনামূল্যে এন্টিভেনমসহ বিভিন্ন সামগ্রী বাংলাদেশ সরকার হাসপাতালে সরবরাহ করেছেন। কোন রাসায়নিক সামগ্রী দিয়ে সর্প দংশন কিংবা সাপকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। দয়া করে রাসেলস্ ভাইপারসহ কোন সাপ মারবেন না। এরা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। মানুষের উপকার করে। আসুন রাসেলস্ ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হই।’
দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, রাজশাহী অঞ্চলে রাসেলস্ ভাইপারের প্রথম অস্তিত্ব মিললেও, এখন এই সাপ বেড়ে ক্রমে বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হযেছে। কিন্তু এই সাপ হঠাৎ করে কেন আর কিভাবে ফেরত এসেছে, তা নিয়ে এখন দেশে গবেষণা চলছে। আমাদের দেশে এই সাপ কাটলে স্নায়ুতে তেমন প্রভাব ফেলে না। তবে, রক্ত জমাট বেঁধে যায়।এমনকি রাসেলস্ ভাইপার সাপ অত্যন্ত বিষধর। এর কামড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যদিও এর প্রতিষেধক রয়েছে। সময় মতো হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিলে এর থেকে বাঁচা সম্ভব।’
অন্যদিকে, রাসেলস্ ভাইপার (Russell’s Viper) বিষয়ে ভারতীয় গবেষক ও চিকিৎসক ডা. প্রদীপ বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, ‘পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দুর্লভ একটি সাপ হলো চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস্ ভাইপার। ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী সাপটিকে সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় রাখা হয়েছে। একটা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকে বিলুপ্ত প্রাণীতে পরিণত করার জন্য অজ্ঞ মহল যেনো উঠে পড়ে লেগেছে।
জানা মতে, রাসেলস্ ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাধারণত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আক্রমণ করে না, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সীমার পর তাকে বিরক্ত করলে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি বছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়।
তবে ‘মানুষকে তেড়ে এসে কামড়ায়’ এ কথা গুজব মাত্র। এরা মূলত ambush predator, তাই এক জায়গায় চুপ করে পড়ে থাকে অর্থাৎ অনেকটাই অলস প্রজাতির। মানুষ বা বড় কোন প্রাণী সামনে এলে S আকৃতির কুণ্ডলী পাকিয়ে খুব জোরে জোরে হিস্ হিস্ শব্দ করে। তারপরও তাকে বিরক্ত করা হলে তবেই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছোবল মারতে পারে।
ছোবল দেওয়ার সময় শরীরের সামনের দিকটা ছুঁড়ে দেয় বলে ঐ “তেড়ে এসে কামড়ায়” জাতীয় ভুল ধারণার জন্ম। এই সাপগুলো গোখরা/পদ্মগোখরার মতোই বিষাক্ত, এবং অন্যান্য সাপের মতোই চন্দ্রবোড়াও সাধারণত মানুষকে এড়িয়েই চলে।
চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমোটক্সিক, অর্থাৎ কামড় দিলে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না, ও বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চন্দ্রবোড়ার বিষ ফুসফুস, কিডনি নষ্ট করে দেওয়ার মতো বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ক্ষতস্থান ফুলে যায়।
হেমোটক্সিক সাপ নিউরোটক্সিকের চেয়ে ধীরে আক্রান্ত করে বিধায় চিকিৎসার জন্য অনেকটা সময় পাওয়া যায় এবং চিকিৎসায় ৭০ ভাগ রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। polyvalent antivenom প্রয়োগ করার মাধ্যমে চন্দ্রবোড়ার বিষেরও প্রতিরোধ সম্ভব।