চট্টগ্রামঃ
প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, পুরো এলাকায় একসাথে কাজ শুরু করলে বিপর্যয় দেখা দেবে। একটির পর একটি ওয়ার্ডে পরিকল্পিতভাবে কাজ পরিচালনার জন্য তিনি ওয়াসা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
এই প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রকল্পের ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গতকাল আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মেয়র। পুরো নগরীকে ছয়টি জোনে ভাগ করে ছয়টি স্যুয়ারেজ এবং দুটি ফিকেল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করা হচ্ছে।
ছয়টি জোনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে একটি জোন বাস্তবায়ন করা হবে। এই জোনে রয়েছে কোতোয়ালী, বাটালি হিল, মাঝিরঘাট, মাদারবাড়ী, আগ্রাবাদ, টাইগারপাস, আমবাগান, নয়াবাজার, চৌমুহনী, উত্তর হালিশহর ও হালিশহর আনন্দবাজার এলাকা।
প্রথম পর্যায়ে উক্ত এলাকাগুলোর প্রায় ২০ লাখ মানুষকে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের আওতায় আনতে কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ২৮ হাজার বাড়িঘরে স্যুয়ারেজের লাইন যুক্ত করা হবে। ২০০ কিলোমিটারের বেশি পাইপ লাইন স্থাপন করা হবে মাটির ৫ থেকে ১৫ মিটার গভীরে।
উক্ত এলাকাগুলো সিটি কর্পোরেশনের ২১টি ওয়ার্ডের আওতাধীন। সিটি মেয়রের শঙ্কা, একই সাথে ২১টি ওয়ার্ডে কাজ শুরু করলে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়বে। তাই একটি ওয়ার্ডের কাজ শেষ করে পরের ওয়ার্ডের কাজ শুরু করার মাধ্যমে প্রকল্পটি শেষ করার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
মেয়রের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, আপনি নগরপিতা। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই কাজ হবে। আমরা শহরটিকে বিশ্বমানের করতে চাচ্ছি। আমরা আপনার সহযোগিতা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করব। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের জন্য রাস্তা খুব বেশি কাটা হবে না। কোনো একটি জায়গায় ছোট পরিসরে রাস্তা কেটে পাইপ ঢুকিয়ে বোরিং করে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যাব।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। এটি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে না। ২০০ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাঝে আমরা সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার রাস্তা কাটব। বাকি ১৯০ কিলোমিটার রাস্তা অক্ষত থাকবে। যেখানে রাস্তা কাটা হবে সেখানেও যান চলাচল কিংবা পথচারী চলাচলে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
গতকাল রাতে নগরীর রেডিসন ব্লু বে ভিউতে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার একেএম ফজলুল্লাহ। সভায় স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাই ওং, জাইকার প্রতিনিধি হিরোসি ইয়োসিকা, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের প্রতিনিধি অন শন জু, সিনো হাইড্রোর প্রতিনিধি এন্ড্রু এবং জেভি অব ইসি ইসির প্রতিনিধি স্প্রিং সাংজাই প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, নগরের কাজে যারা সম্পৃক্ত, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে সিস্টেমে করতে হবে। রাস্তা অনেক গভীর করে কাটা হলে পুরো রাস্তা ধসে পড়বে। আমাদের রাস্তার ধারণ ক্ষমতা ১২ টন। যে লরিগুলো বন্দর থেকে বের হয় সেগুলো ৪০ থেকে ৫০ টন। তাই এ প্রকল্পের সাথে যারা জড়িত আছেন সবাইকে এ কাজ সম্পর্কে অবগত করতে হবে।
তিনি বলেন, নগরীতে আগে সুপেয় পানির বহু উৎস ছিল। পুকুর ছিল, জলাধার ছিল। এখন সেসব নেই। টিউবওয়েলেও পানি আসে না। নগরীতে বাকলিয়া, পতেঙ্গা, এমনকি লালখান বাজারের একটু উঁচু এলাকাতেও পানি পাওয়া যায় না। তিনি নগরীতে সুপেয় পানির সংস্থান করার জন্য ওয়াসার প্রতি আহ্বান জানান।
বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, অনেকে ছাদে সুইমিং পুল করে। সুইমিং পুল না করে বহুতল ভবনগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগাতে হবে। ছাদে সুইমিং পুল না করে জলাধার করারও প্রস্তাব দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সিডিএকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
মেয়র বলেন, শহরে বহু মানুষ পানির কষ্টে আছে। আগে পুকুর ছিল। এখন সব পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে বিল্ডিং। আমাদের পরিকল্পনা করা উচিত। পানির অভাবে মানুষ ক্ষুদ্ধ হচ্ছে। একসময় মানুষ আবারো কলসি নিয়ে ওয়াসার সামনে বিক্ষোভ করবে।
পানির লেয়ার অনেক নিচে গেছে। ডিপ টিউবওয়েলেও পানি না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোথাও কোথাও পানিতে প্রচুর আয়রন। খাওয়া যায় না। তাই সুপেয় পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিয়ে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি।
স্যুয়ারেজ প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, এ প্রকল্পের কোনো বিকল্প নেই। চটগ্রামে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে। ৭০ লাখ মানুষ রয়েছে। এছাড়া গ্রামের মানুষও নগরমুখী। পরিকল্পিত না হলে এ নগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।
গেস্ট অব অনারের বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, পানির অপর নাম জীবন। ওয়াসা এই জীবন রক্ষার পানি সরবরাহ দেয়, এজন্য তাদের ধন্যবাদ। তবে শহরের বহু এলাকায় এখনো পানি যায় না। শহরের প্রতিটি ঘরে যাতে পানি পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে ওয়াসার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে আজাদী সম্পাদক বলেন, বর্তমানে নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পানি নদীতে পড়ছে। ২০৩০ সালে এর পরিমাণ প্রতিদিন ৫১৫ মিলিয়ন লিটার হবে।
এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৫৩৯ ঘনমিটার ফিকেল স্লাজ সেপটিক ট্যাংকে জমা হচ্ছে, যা ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ৭১৫ ঘনমিটার হবে। ফলে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে, যা সার্বিকভাবে চট্টগ্রামের পরিবেশ দূষণ করছে। ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহে সংকট সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, পরিকল্পিত কোনো স্যুয়ারেজ সিস্টেম গড়ে না ওঠায় বছরের পর বছর ধরে টয়লেটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম মহানগরী শূন্যের কোটায় রয়েছে, যা ঘুরেফিরে উন্মুক্ত মলমূত্র ত্যাগের মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে। একটি হেলদি সিটির জন্য স্যুয়ারেজ সিস্টেম থাকা অত্যাবশ্যক বলে মন্তব্য করে দৈনিক আজাদী সম্পাদক বলেন, এই প্রকল্পটি আমাদেরকে বিশ্বমানের নগরীর দিকে এক ধাপ এগিয়ে নেবে।
এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প গ্রহণ করায় চট্টগ্রাম ওয়াসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি আরো অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। তবে বিলম্বে হলেও শুরু করায় আপনাদের ধন্যবাদ। ঢাকায় অনেক আগে হয়েছে। ঢাকা থেকে একশ বছর পিছিয়ে চট্টগ্রাম।
১৯২৩ সালে ঢাকায় স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলেও স্যুয়ারেজ করা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।