আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে আমিরের নির্দেশে পার্বত্যাঞ্চল ছেড়ে সমতলে ছড়িয়ে পড়ছে ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা। পটিয়ার চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের বাইপাস থেকে মঙ্গলবার রাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ‘তাত্ত্বিক জ্ঞান’ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বম পার্টির (কেএনএফ) সঙ্গে মিলে গহিন বনে আস্তানা গেড়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও চট্টগ্রাম জোনের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত টিম এ অভিযান চালায়। গ্রেপ্তার চারজন হল– পটুয়াখালী দশমিনা এলাকার হোসাইন আহমদ (২২), কুমিল্লা সদরের নিহাল আব্দুল্লাহ (১৯) ও মো. আল আমিন (২২) এবং খুলনা ডুমুরিয়ার আল আমিন ওরফে পার্থ (২১)।
এদের মধ্যে আল আমিন ওরফে পার্থ ধর্মান্তরিত মুসলিম। গ্রেপ্তার চার তরুণ ছয় মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।
র্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রশিক্ষণে গিয়েছিল এমন একটি দল আত্মগোপন করতে কিংবা তাদের পরবর্তী মিশন সম্পন্ন করতে সমতলের দিকে আসছে এমন তথ্য পায় র্যাব। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে পটিয়া বাইপাসের চেকপোস্টে একটি সিএনজি টেঙি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তারা চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশ করছিল। এদের মধ্যে নিহাল ২০২২ সালের আগস্টে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের একজন, যিনি কথিত হিজরতের জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন। নিহালকে নিয়ে ওই আটজনের সবাই এখন গ্রেপ্তার হলেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের বরাত দিয়ে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, তাদের পেছনে ৪/৫ জনের আরেকটি দল ছিল; যারা চেকপোস্ট দেখে পালিয়ে যান। গ্রেপ্তারকৃতদের থেকে বিভিন্ন তথ্যসহ কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে জানিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, এটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর আগে গত ২৪ জানুয়ারিও এ ধরনের একটি ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া গেছে।
র্যাব জানায়, হোসাইন রাজধানীর একটি মাদরাসায় অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০২১ সালের নভেম্বরে নিখোঁজ হন। আল আমিন কুমিল্লার একটি মাদরাসায় পড়া অবস্থায় একই বছরের আগস্টে নিরুদ্দেশ হন। নিহাল আবদুল্লাহ ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই বছরের আগস্টে তিনিও ঘর ছেড়ে যান। ২১ বছর বয়সী আল আমিন ওরফে পার্থ, তার বাড়ি খুলনায় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে।
তখনকার পার্থ কুমার দাশ ২০১৮ সালে স্থানীয় এক ইমামের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম পরিবর্তন করেন। এরপর ঘর ছেড়ে রাজধানীতে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি নেন। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন জানান, হোসাইন ও আল আমিন ওরফে পার্থ জনৈক সিরাজের মাধ্যমে শারক্বীয়া সংগঠনে যোগ দেন। আল আমিনকে তার মাদরাসার সহপাঠী ফাহিম এবং নিহালকে কুমিল্লার কুবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহ সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। সংগঠনে যোগ দেয়ার পর তাদের প্রত্যেককে প্রথমে তাত্ত্বিক ও শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ধর্মীয় বিভিন্ন অপব্যাখা দিয়ে এবং প্রতিবেশী দেশে কথিত মুসলিম নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কুমিল্লা, পটুয়াখালী, ভোলা, সাভার, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তুলে দেওয়া হয় শারক্বীয়ার অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবের কাছে। রাকিব তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও রণকৌশল শেখানোর জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বাকলাই পাড়া হয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
খন্দকার মঈন আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে শারক্বীয়ার সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। শারক্বীয়ার আমীর আনিসুর রহমান মাহমুদের ঘনিষ্ঠজন কেএনএফ’র প্রধান নাথাম বম। আমীরের অনুরোধে পাহাড়ে অর্থের বিনিময়ে আশ্রয়, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, বোমা তৈরি এবং অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের কাজ করছিল কেএনএফ।
বিভিন্ন সময় কেএনএফ প্রধান নাথান বম, বাংচুং, রামমোয়, ডিকলিয়ান, পাহল এবং কাকুলীসহ অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেছেন। পরবর্তীতে র্যাবের অভিযানের মুখে আমীরের নির্দেশে শারক্বীয়ার সদস্যরা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে পার্বত্য অঞ্চলের সাইজামপাড়া, মুন্নুুয়াম পাড়া, রোয়াংছড়ি, পাইক্ষংপাড়া, তেলাং পাড়ায় আত্মগোপন করে থাকে।
গ্রেপ্তার চারজন আত্মগোপনের জন্য বান্দরবান থেকে সমতলের দিকে এসেছিল। চারদিন হেঁটে তারা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বান্দরবানের টঙ্কাবতী এলাকায় আসে। এরপর সিএনজি টেক্সি করে পটিয়া বাইপাস এলাকায় এসে ধরা পড়ে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট তরুণ নিখোঁজের একটি ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হলে অনুসন্ধানে নেমে র্যাব ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সন্ধান পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন তথ্য পায় র্যাব।
মাসখানেক ধরে গোয়েন্দা নজরদারির পর অক্টোবর থেকে রাঙামাটির বিলাইছড়ি, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, থানচি, কক্সবাজারের কুতুপালংসহ বিভিন্ন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে র্যাব। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত র্যাবের অভিযানে শারক্বীয়ার মোট ৫৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যার মধ্যে সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন জঙ্গী নেতা আছেন।
এছাড়া তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া কেএনএফ’র ১৭ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
এর আগে র্যাব কথিত হিজরতের উদ্দেশে বেরিয়ে যাওয়া ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। মঈন জানান, এর মধ্যে সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া চার তরুণসহ ২৭ জনের সন্ধান পেয়ে র্যাব তাদের উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দুজন নিহত হয়েছেন এবং পুলিশ দুজনকে শনাক্ত করেছে। আরও ২৪ জন এখনও নিখোঁজ আছেন।
র্যাব জানায়, শারক্বীয়া ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ মোট পাঁচটি মামলা আছে। বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ি, রাঙামাটির বিলাইছড়ি, কুমিল্লার লাকসাম এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় এসব মামলা দায়ের হয়েছে। গ্রেপ্তার চার তরুণকে বিলাইছড়ি থানার মামলায় হস্তান্তর করা হয়েছে।