আন্তর্জাতিক অনলাইন ডেস্কঃ
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তার দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে যদিও সেটা এখনও সরকারের সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক ঘোষণা নয়। দেশ যে ‘গর্তে’ পড়তে যাচ্ছে, তারই প্রভাব হয়ত তার কথায়।
তবে পাকিস্তানের অর্থনীতি যে সত্যিই খাদের কিনারে পৌঁছেছে, তাতে কারো সন্দেহ নেই। আতঙ্ক, উদ্বেগ জেঁকে বসেছে দেশটির মানুষদের মধ্যে। মূল্যস্ফীতিতে উঠেছে নাভিশ্বাস। ধস নেমেছে পুঁজিবাজারে।
২০২১ সালের জুনে পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক ছাড়িয়েছিল ৪৮ হাজার পয়েন্ট। সেটা নেমেছে ৪০ হাজারে এবং ক্রমাগত নামছেই।
এ পরিস্থিতিতে দেশটি তাকিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দিকে। আর ঋণ নিশ্চিত করতে পূরণ করতে হচ্ছে একের পর এক শর্ত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ায় দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ডলার সংকটে খাদ্যপণ্য ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের আমদানিও বন্ধ হওয়ার দশা।
এর মধ্যে সোমবার দেশটির জাতীয় পরিষদে একটি সম্পূরক অর্থবিল পাস করা হয়েছে। তাতে আরও করের চাপ চাপতে যাচ্ছে জনগণের ওপর।
আগামী সাড়ে চার মাসের মধ্যে শাহবাজ শরিফ সরকার নতুন করে রাজস্ব হিসেবে ১৭ হাজার কোটি রুপি বাড়তি আদায় করতে চায়। এটা করতে হচ্ছে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে।
দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ যদিও গত সপ্তাহে কিছুটা বেড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, তার পরও দেশটির রেটিং কমিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান এজেন্সি ফিচ। তাদের বিবেচনায় পাকিস্তান এই মুহূর্তে ‘খেলাপি হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে’ আছে।
হাতে থাকা তিন বিলিয়ন ডলারে কেবল ১৬ থেকে ১৭ দিনের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এরপর শ্রীলঙ্কার মত পরিণতি যেন না হয়, সেজন্য গত কয়েক মাস ধরে আইএমএফের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। এ নিয়ে নয় দফার বৈঠকেও কর্মকর্তা পর্যায়ের কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি দুই পক্ষ।
ওই ঋণের প্রথম কিস্তির ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের আশায় উদগ্রীব হয়ে আছে পাকিস্তান। দেশটি আশা করছে, আইএমএফের ঋণ পাওয়া গেলে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকেও সহায়তা আসবে।
এই ঋণ পাওয়ার আশায় গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১০ দিন আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে দেশটির সরকার। তবে চূড়ান্ত ঐকমত্য হয়নি।
আইএমএফ জানিয়েছে, তাদের আলোচনা এখনও ভেস্তে যায়নি। চুক্তি চূড়ান্ত করতে আগামী দিনেও আলোচনা চালু থাকবে।
আইএমএফ থেকে ঋণ যদি মেলেও, তারপরও পুরোপুরি স্বস্তিতে থাকতে পারছে না পাকিস্তান। কারণ চলতি বছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে, সেই পরিমাণ ডলার জোগাড় করা কঠিন হয়ে যাবে দেশটির জন্য। এক হিসাব অনুযায়ী আগামী ১২ মাসে ২২ বিলিয়ন ডলার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে পাকিস্তানকে।
আইএমএফের ঋণ নিশ্চিত করতে তাদের শর্ত পূরণে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার জাতীয় পরিষদে সম্পূরক অর্থবিল উত্থাপন করেন। দুই দিন পর থেকে শুরু হয় আলোচনা।
আইএমএফের সঙ্গে ১০ দিনের আলোচনাকে ‘বিরাট পেরেশানি’ হিসেবে বর্ণনা করে পার্লামেন্টে অর্থমন্ত্রী বলেন, তাদেরকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নইলে দেশের অর্থনীতি আরও তলানিতে নামবে।
তার দাবি, তারা যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে চাইছেন, তা দেশটির গরিব মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। এটি কেবল বিলাস দ্রব্য আমদানি ও বিক্রির ওপর থেকে নেওয়া হবে। গরিব মানুষকে সহায়তা করতে ‘বেনজীর ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম’-এ বরং ৪ হাজার কোটি রুপি দেওয়ার প্রস্তাবও করেছেন তিনি।
বিদ্যুৎ খাতে বছরে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি রুপি লোকসানকে ‘পাহাড়চুম্বি’ হিসেবে বর্ণনা করেন ইসহাক দার। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আইএমএফও উদ্বেগ জানিয়েছে।
সরকার বিদ্যুৎ খাতে বছরে তিন লাখ কোটি রুপি খরচ করে কেবল এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি আয় করে বলেও জানান তিনি। এই খাতে চুরি, কম দামে বিক্রি, সিস্টেম লস ও খেলাপি বিলের কারণে বাকি অর্থ লোকসান হয়।
পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী জানান, এই লোকসান কমিয়ে আনার বিষয়ে পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই আলোচনা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পথনকশা ঘোষণা করবেন।
দেশটির এই পরিস্থিতির জন্য এর আগের ইমরান খান সরকারের ‘দুর্বল ব্যবস্থাপনা’ এবং ‘আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব’কেও দায়ী করেন ইসহাক দার।
ইমরান খানের পিটিআই সরকার আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে পতনের আগে ‘অর্থনীতিতে নাশকতা’ করেছে বলে অভিযোগ বর্তমান অর্থমন্ত্রীর। তিনি বলেন, আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি রক্ষা করা রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার বিষয় ছিল। সেটি না করায় বর্তমান সরকারকেই তা করতে হচ্ছে।