চট্টগ্রামের সময় ডেস্কঃ
মাদক পরিবহনে প্রশাসনের নজর এড়াতে নিত্য নতুন কৌশল আর রুট পরিবর্তনকে বলা হয় এ ব্যবসার প্রধান মূলধন। মিয়ানমারের ৪৫টি ইয়াবা কারখানায় তৈরি ইয়াবার চালানে প্রায় প্রতিদিনই লাখ লাখ ইয়াবা প্রবেশ করছে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে।
মিয়ানমার থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর সাড়ে ৩শ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। বাংলাদেশের বাজারকে টার্গেট করে মিয়ানমারের এ ইয়াবা কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে ১৩ ধরনের ইয়াবা।
প্রতিমাসে এসব ইয়াবা ঢুকছে ২২টি রুট দিয়ে। দেশের কারাগারগুলোতে মোট আসামির ৭০ ভাগই মাদক মামলার। এদের বেশিরভাগই শুধু বাহক। মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে মাদক আমদানি করেই চলেছে।
পাচারে নিত্য নতুন পথ : ইয়াবার উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার থেকে নৌপথে প্রবেশ করতো ইয়াবা। এরপর চোরাচালানে নতুন সংযোজন হয় স্থলপথ ও পাহাড়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর গহীন অরণ্য হয়ে উঠে ইয়াবা পাচারের অভয়ারণ্য।
মিয়ানমার থেকে স্থল পথে মোরং পাহাড় হয়ে বান্দরবানের আলীকদম–থানচিসহ আশপাশের ৬টি পাহাড় মাদক চোরাচালানের নতুন পথ হয়ে উঠে। পাহাড়ের দুর্গম পথ ধরে এসব ইয়াবা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম–ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় ইয়াবা পাচারে ব্যয়বহুল বেসরকারি হেলিকপ্টারের ব্যবহার।
নিত্য নতুন কৌশলে পাচার : অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান দেশে আনতে ও দেশের ভেতর বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন কারবারিরা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে শুধু নতুন রুটই না, নতুন নতুন মুখও ব্যবহার করা হচ্ছে।
একই চালানকে কয়েক ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন রুটে পাঠানো হচ্ছে। কঙবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারে আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে ১৫টি রুট। এই ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কঙবাজার আর পাঁচটি বান্দরবান সীমান্তে। মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা উৎপাদন করা হচ্ছে।
নতুন যুক্ত হয়েছে আরও ৭টি রুট : সর্বশেষ তথ্য মতে, নতুন আরো সাতটি আন্তর্জাতিক রুট ধরে বর্তমানে মিয়ানমারের শান প্রদেশ ও আশপাশের এলাকা থেকে বাংলাদেশে আসছে ইয়াবা ও আইস।
কৌশল পরিবর্তন করে তাঁরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ (আইস) পাচারে বেছে নিয়েছে সাতটি নতুন রুট। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের মিজোরাম, আসাম ও মণিপুর হয়ে ত্রিপুরার দুটি রুট আর বান্দরবান, কঙবাজার, বরিশাল, যশোর ও সাতক্ষীরার পাঁচটি রুট। নতুন এই রুটগুলো হলো মিয়ানমারের শান প্রদেশ – তুয়াঙ্গি – ইয়াংগুন হয়ে নৌপথে মহেশখালী।
মিয়ানমারের সিত্তে হয়ে গভীর সাগরপথ ঘুরে বরিশাল উপকূলের ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, মিয়ানমারের মান্দালে – তুয়াঙ্গি – মাগওয়ে – মিনুর – পাদান – সিত্তেই – মংডু হয়ে টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, মান্দালে – সাগাইং অঞ্চল – মনোয়া – কালে – মোরে (মণিপুর) আইজল (মিজোরাম) – পানিসাগর – শিলং – করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ, শিলং – শিলিগুড়ি – মালদা হয়ে যশোর এবং সাতক্ষীরার তিনটি এলাকা দিয়ে দেশের ভেতর ঢুকছে মাদকের চালান।
অন্যান্য দেশেও পাচার : প্রত্যেকটা ইয়াবা চালানের রুট পর্যালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, পুরাতন কোনো রুট অনুসরণ করছে না ইয়াবা কারবারিরা।
তারা এ কাজে ব্যবহার করছে নিত্য নতুন রুট। শুধু বাংলাদেশ নয়; ভারত, চীন, লাওস, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, আইস, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক পাচারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর নেশা ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন বা এমফিটামিনের যোগান আসে মিয়ানমারের শান স্টেট থেকে।
ভারত হয়ে ঢুকছে ইয়াবা : ইয়াবার কিছু কিছু চালান ভারত হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আজাদীকে জানান, মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা বেশি ব্যবহার করছে ভারতের সীমান্ত।
তাঁরা ভারতের ত্রিপুরাকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখান থেকে একটি রুটে মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম ও আসাম হয়ে ত্রিপুরায় পৌঁছায় মাদক। আরেকটি রুটে মণিপুর হয়ে ত্রিপুরায় যায় মাদকের চালান। আর সেখান থেকে আসছে বাংলাদেশে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, এ দুই রুটের কারণে ইয়াবা চোরাচালান এখন আগের চেয়ে সহজ হয়ে গেছে। চাহিদা ও জোগান কোনোটিই কমানো যাচ্ছে না। এ কারণে এর প্রবেশ ঠেকালেও নতুন নতুন রুট বের করছে কারবারিরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রসায়নবিদ ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ত্রিপুরার সঙ্গে আমাদের ল্যান্ড বর্ডার। এ ছাড়াও আরেকটা হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে মণিপুর। ভারতের দুই অঙ্গরাজ্য হয়ে বাংলাদেশে মাদক প্রবেশ করছে।
ডিএনসির চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, মূলত নতুন সাতটি রুটে বর্তমানে মিয়ানমার থেকে দেশে আসছে ইয়াবা ও আইস।
মিয়ানমারের ৭টি গ্রুপ জড়িত : শান স্টেট থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত মিয়ানমারভিত্তিক ৭টি সন্ত্রাসী গ্রুপ। যার মধ্যে রয়েছে– শান স্টেটভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, ইউনাইটেড স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউসিএ), আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া বাহিনীসহ কয়েকটি চক্র।