আন্তর্জাতিক অনলাইন ডেস্কঃ
যে দিকে চোখ যায়, শুধুই ধ্বংসের ছবি। চারদিকে কান্নার রোল। একের পর এক উদ্ধার হচ্ছে মৃতদেহ। ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর তুরস্ক এবং সিরিয়ার ছবিটা ঠিক এরকমই। যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে এই দুই দেশ। গত ৮৪ বছরে এমন ভূমিকম্প দেখেনি তুরস্ক। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুদেশে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বহু বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টার দিকে কেঁপে ওঠে তুরস্ক এবং সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। রিখটার স্কেলে সেই কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপের কাছে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটিতে প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং সাইপ্রাসও কেঁপে ওঠে। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রধান বলেন, তার দেশেনিহত বেড়ে ১৭৬২ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে সিরিয়ায় নিহত বেড়ে ১০৭৩ জনে। তারপর দুদেশে মৃতের সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইপ এরদোয়ান ১৯৩৯ সালের পর একে তার দেশের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সে বছরও তুরস্কে কম্পনের তীব্রতা ছিল ৭.৮। এরজিনকান প্রদেশে ভূমিকম্পে সে বার ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ৭ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প গত ২৫ বছরে ৭ বার অনুভূত হয়েছে তুরস্কে।
ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) মতে, গতকাল প্রায় দেড় মিনিট পর্যন্ত তার কম্পন অনুভূত হয়। প্রাথমিকভাবে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর বেশ ক’টি ‘আফটারশক’ হয়। বিবিসি জানায়, সোমবার ভোররাতে গাজিয়ানতেপের কাছে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। তখন সব মানুষ ঘুমে।
স্থানীয় সময় আনুমানিক বেলা দেড়টায় সেখানে ৭.৫–মাত্রার নতুন এক কম্পন আঘাত হানে। এরপর সন্ধ্যায় আবারও একটা কম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে তৃতীয় ভূমিকম্পের তীব্রতা ৬। গত ২৪ ঘণ্টায় এই নিয়ে ৩ বার কম্পন অনুভূত হল দুই দেশে।
কম্পনের জেরে হুড়মুড়িয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে থাকে একের পর এক বহুতল এবং বাড়ি। সেই বাড়িগুলির নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষকে বাঁচাতে উদ্ধারকর্মীরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। দুর্গত এলাকা থেকে যেসব মর্মান্তিক ছবি পাওয়া যাচ্ছে তাতে বাসাবাড়ি ও সড়কে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকদের সন্ধানকারী উদ্ধারকারী দলগুলোকে মরীয়া হয়ে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।
তুরস্কের ১০টি শহর ও প্রদেশের স্কুল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি হাতায়, মারাশ এবং আন্তেপের বিমানবন্দরগুলো বন্ধ বা আংশিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারাস, হতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস–এই ১০টি শহর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিরিয়ায় নিহতদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধ–বিধ্বস্ত বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। এই অঞ্চলটির সীমান্তের উভয় পাশে শিবিরগুলিতে লক্ষাধিক সিরীয় শরণার্থীর আবাসস্থল। ভূমিকম্পে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই সেখানে চিকিৎসা সেবা এবং জরুরি সরবরাহের সুযোগ সীমিত। সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করা একটি ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেট জরুরি সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছে।
তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় আগামী কয়েক দিনে ভারি বৃষ্টি ও তুষারপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে বিবিসি। সেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকবে এবং রাতের বেলা তা আরো কমে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। এমনকি ওই এলাকা ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার গভীর তুষারে ঢেকে যেতে পারে। পাহাড়ে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হতে পারে। এই অবস্থায় যদি বৃষ্টি ও তুষারপাত শুরু হয় তবে সেটাও অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে।
তুরস্ক সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক আবেদন জানানোর পর বিশ্ব নেতারা সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।সিরিয়া ও তুরস্ককে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান উভয়ের সঙ্গে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা রয়েছে। রাশিয়া জানিয়েছে, উদ্ধারকর্মীদের নিয়ে তাদের দুইটি ইলিউশিন–৭৬ উড়োজাহাজ তুরস্কে উড়ে যেতে এবং উদ্ধার কাজে হাত লাগাতে প্রস্তুত আছে। একশ উদ্ধারকর্মীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও জানায় দেশটির জরুরি মন্ত্রণালয়।
এছাড়া তুরস্কে উদ্ধার তৎপরতায় সহায়তার নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। একই সঙ্গে ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের ঘটনায় গভীর উদ্বেগের কথাও জানিয়েছে বাইডেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এ তথ্য জানিয়েছেন।
তুরস্ক পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোর একটিতে অবস্থিত। বিবিসি লিখেছে, ৮০ বছর আগে এর সমান শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প দেখেছিল তুরস্ক। ১৯৩৯ সালের সেই ভূমিকম্পেরও মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮; তুরস্কের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের ওই ভূমিকম্প অন্তত ৩০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল।
সর্বশেষ ভূমিকম্পটি ঘটেছে তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্ব সীমান্তের কাছে দক্ষিণ–পশ্চিম থেকে উত্তর–পশ্চিমমুখী ‘পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট’–এর চারপাশে। সিসমোলজিস্টরা দীর্ঘকাল ধরে বলে আসছেন যে এই ফল্টটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, যদিও গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে কোনও উল্লেখযোগ্য কার্যকলাপ হয়নি। তবে অতীতে এই এলাকায় কিছু মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছে।