চট্টগ্রামঃ
আয়ের সহজ পথ হিসেবে নগর জুড়ে অনেকে বেছে নিয়েছেন জুয়া খেলাকে। তাতে উল্টো সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে তারা। অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছে সিন্ডিকেটবদ্ধ জুয়াড়িদের পকেট। নগর জুড়ে এখন জুয়া খেলার রমরমা বাণিজ্য চলছে। পুলিশ এক স্থানে হানা দিলে একদিন বন্ধ থাকার পর জুয়াড়িরা অন্য স্থানে নতুন আসর খুলে বসছে।
নগরীতে জুয়ার আসরগুলো উচ্ছেদে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজও করছে নগরীর প্রতিটি থানার পুলিশ কর্মকর্তাগণ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’ থাকার মতো নগরীর অনেক স্থানে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে দায় সারছে পুলিশ, আবার অনেক স্থানে অভিযানের কথা আগেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, জুয়াড়িদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু জামিনে তারা দ্রুত বের হয়ে নতুন কোনো স্থানে আবারো জুয়ার আসর বসিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জুয়া খেলার সরঞ্জাম এবং নগদ টাকাসহ ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কিন্তু জামিনে বের হয়ে তারা পুনরায় জুয়ার নেশায় মেতেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ জুয়া খেলায় জড়িত। জুয়া খেলার অপরাধে সাজা কম হওয়ায়, তারা ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে ফিরে যায় জুয়ার আস্তানায়। এখন বাসা বাড়ি, হোটেল, মেস, ছাত্রাবাস, রেল ও বাস স্টেশন, বাজার ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন নির্জন স্থানে জুয়া খেলা চলছে।
অভ্যাসগত জুয়াড়িরা পকেটে টাকা আছে কি নেই; সে নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা একবার জুয়ায় বসে ক্রমাগতভাবে হারতে থাকলেও দেখা যায় অন্য জুয়াড়িদের থেকে ধারকর্জ করেও খেলা অব্যাহত রাখে। জুয়া খেলায় হার–জিত থাকায় সমন্বয় করলে দেখা যায়; বেশির ভাগের ক্ষেত্রে হারের পাল্লাটাই ভারি।
অভ্যাসগত জুয়াড়িদের অনেকে জুয়া খেলতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে; এমন নজির অহরহ। এদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের মানুষ। অভ্যাসগত জুয়াড়িদের মধ্যে অনেকে হেরে যখন শূন্য পকেটে ঘরে ফেরে, তখন স্ত্রীর উপর চড়াও হয়।
এদিকে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, জুয়া খেলার অপরাধে জেলা প্রশাসকগণ সাজা বাড়ানোর ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন। তা বিবেচনায় নিয়ে দেড়শ বছরেরও বেশি পুরনো আইনটি ‘যুগোপযোগী করার’ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এই আইনটি ব্রিটিশ আমলের আইন। আইনটি কোথা থেকে কিভাবে হয়েছিল সেটা আমরা খুঁজে বের করেছি।
প্রসঙ্গত: দেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ নামে যে আইনটি রয়েছে তাতে সাজার পরিমাণ খুবই নগন্য, মাত্র ২০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদন্ড।
নগরীতে প্রায় প্রতি দিনই কোনো না কোনো থানা এলাকায় জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে জুয়াড়িরা। বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুল হক জানিয়েছেন গত বুধবার (২৬ জানুয়ারি) মিয়াখান নগর এলাকার সাবান ফ্যাক্টরি গলিতে জুয়ার আস্তানায় হানা দিয়ে ২৪ জন জুয়াড়িকে আটক করে পুলিশ। এসময় তাদের থেকে তাসের বান্ডিল ও নগদ ১৭ হাজার ৩৩০ টাকা জব্দ করা হয়।
বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান জানান, শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) রাত ১০টায় হাজীপাড়া আজগর শাহ মাজারের পেছনে জুয়ার আসর থেকে সরঞ্জামসহ ৪ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা ও জুয়া খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল কবির বলেন, ২০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১ টার দিকে পুরাতন ডাকঘর এলাকায় এক জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে ৯ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসময় তাদের থেকে জুয়া খেলার সরঞ্জাম ও নগদ ২১ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
১৯ জানুয়ারি রাত ১০টায় বায়েজিদ থানার আরেফিন নগর এলাকার কাগতিয়া মার্কেটের পিছনে রিপনের কলোনির রিপনের ঘরে জুয়ার আসর থেকে ৯ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৩৫৭০ টাকাসহ তিন বান্ডিল তাস জব্দ করা হয়।
১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়কের নতুন ব্রিজ মোড়ের নতুন ব্রিজ–ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে ৫ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে জুয়া খেলার লোহার চরকি এবং নগদ ১৯২০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
১৪ জানুয়ারি রাত ৯ টার দিকে চৌমুহনী সংলগ্ন এলাকার একটি জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে নগদ সাড়ে ৪৯ হাজার টাকাসহ ৮ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুর রহমান জানান, ৮ জানুয়ারি রাত ৮টায় চান্দগাঁওয়ে একতা বাজারের শাহাজী মাজার গেটের সামনে জুয়ার আসর থেকে জুয়া খেলার সরঞ্জামসহ তিন জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির বলেন, ৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় পাঁচলাইশের হাদুমাঝি পাড়ায় একটি জুয়ার আসর থেকে ১৪ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসময় তাদের থেকে ৫ বান্ডিল তাসসহ নগদ ১০ হাজার ৫৮৭ টাকা জব্দ করা হয়।
১ জানুয়ারি রাত ৯টায় চান্দগাঁও থানার বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটার ছবুর বাপের বাড়ির মুছার বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার একটি জুয়ার আসর থেকে পাঁচ জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসময় ৩ হাজার ৫০ টাকাসহ পাঁচ প্যাকেট জুয়া খেলার তাস জব্দ করা হয়।