শায়খ মুহাম্মদ মুহি উদ্দীন আযহারীঃ
‘তরিকত’ মানে আল্লাহর দিকে বান্দার প্রত্যাবর্তনের পথ। এই পথের দুটি দিক রয়েছে। জাহের ও বাতেন। বাহ্যিক শরীয়ত পালনের মাধ্যমে বান্দা তার জাহেরকে পবিত্র করে আর সাথে সাথে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে হাকীকতে শরীয়ত ও ধর্ম পালনের নিগুঢ়তম উদ্দেশ্য সাধনে ব্রতী হয়। এই চর্চাই সূফী তরিকার মৌলিক ভাব।
‘তরিকত’ ইসলাম ধর্মে কোন নব আবিষ্কার নয়। ইসলামের প্রথম যুগে আধ্যাত্মিক সাধনার ছায়ায় তরিকতের হাকিকত বর্তমান ছিল। হযরত রাসুল (সাঃ) সাহাবাদেরকে ধর্মীয় দিকনির্দেশনার অংশ হিসেবে আধ্যাত্মিক সাধনার তালীম ও তারবিয়ত দিয়েছেন। এমনকি ‘বাইয়াতে ইসলাম’ গ্রহনের পরও সাহাবাদের কাছ থেকে হযরত রাসুল (সাঃ) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাপারে পুনঃ বায়াত গ্রহণ করেছেন।
আল কোরআনে তরিকত চর্চার হাকীকতঃ রূহানী উৎকর্ষ সাধনের ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পন্থার অস্তিত্বের ইঙ্গিত পবিত্র কোরআনেই রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলছেন, “যারা আমার পথে সাধনা করে, অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার অনেকগুলো পথ প্রদর্শন করবো।
নিশ্চই আল্লাহ তায়ালা ইহসানকারীদের সাথে আছেন”। (সূরা আনকাবুত, ৬৯)। এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালার অনেকগুলো পথ প্রদর্শন করার কথা বলেছেন।
তরিকত চর্চার অন্যতম মৌলিক বিষয় হচ্ছে যে, এগুলো আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে কোন না কোন একজন আল্লাহর ওলীর পদাঙ্ক অনুসরন করে। এভাবে আল্লাহর ওলী তথা যারা আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে তার নৈকট্য অর্জন করেছে তাদের পদাঙ্ক ও পথ অনুসরন করার জন্য পবিত্র কোরানে তাগিদ এসেছে। আল্লাহ বলছেন, “যে ব্যক্তি আমার দিকে রুজু হয়েছে তার পথ অনুসরন কর।” (সূরা লোকমান, ১৫)।
মাইজভাণ্ডারী তরিকাঃ ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিক সাধনার সূদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কোরান ও হাদীসের মৌলিক শিক্ষাকে আশ্রয় ও আত্মস্থ করে অনেক তরিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
যেমন, কাদেরিয়া, মুজাদ্দেদীয়া, নকশবন্দীয়া, চিশতিয়া ইত্যাদি। এরই ধারাবাহিকতায় উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে কোরান ও হাদীসের শিক্ষাকে অনুসরন করে গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ) এর আধ্যাত্মিক শক্তি ও শিক্ষাকে ধারন করে একটি তরিকা প্রচারের সূচনা হয়।
হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (রহঃ) বলেন, “এই ত্রিবিধ বেলায়তী ধারা, নবূয়তী ধারার সমন্বয়ে অর্থাৎ জাহের বাতেন তা’লীমে এরশাদী সহ শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মায়ারেফত প্রভাবে ও সংমিশ্রণে মাইজভাণ্ডারী তরীকারূপ মহাসাগরের উৎপত্তি।”
এই তরিকার প্রথম বুজুর্গ ও প্রচারক গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) নিজগ্রাম ‘মাইজভান্ডার’ এর কারণে ‘মাইজভাণ্ডারী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাই তার অনুসৃত ও প্রচারিত আধ্যাত্মিক সাধন পদ্ধতি বা তরিকা ‘মাইজভাণ্ডারী তরিকা’ হিসেবে জনসমাজে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
মাইজভাণ্ডারী তরিকার মানব কল্যাণকামী বৈশিষ্ট্যঃ এই ত্বরিকা ছিলাছিলার দৃষ্টিকোনে কাদেরিয়া ত্বরিকার সাথে সর্ম্পকিত। অন্যান্য ত্বরিকার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্টগুলো মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকায় একত্রিত হয়েছে।
এই ত্বরিকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এ ত্বরিকা ইসলামী ভাবাদর্শকে পরিপূর্ণভাবে আত্বস্থ করার পাশাপাশি একই সাথে অসাম্প্রদায়ীক, উদার ও সংস্কারমুক্ত, নৈতিক ধর্ম–প্রাধান্যসম্পন্ন, শ্রেণী–বৈষম্যহীন ও মানবদরদী।
মাইজভাণ্ডারী তরিকার কর্মনীতি ও শিক্ষাঃ ইসলাম ধর্মের পূর্নাঙ্গ অনুসরনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন মাইজভাণ্ডারী তরিকার মূল লক্ষ্য। এই তরিকার কর্মনীতির অন্যতম হচ্ছে খেলাফতপ্রাপ্ত পীরে তরিকতের হাতে বায়াত গ্রহনের পর জিকির চর্চার মাধ্যমে নিজ ক্বালবকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা।
মানুষের মনে ঐশী প্রেম জাগ্রত করে সুন্দর ও ন্যায়ের পথে জীবন যাপনে মানব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করার শিক্ষা ও দীক্ষা দেয়।
উসুলে সাবআ সপ্তকর্ম পদ্ধতিঃ জিকিরের পাশাপাশী নফছে ইনসানীর কুপ্রবৃত্তি বন্ধ করে রূহে ইনসানীর সুপ্রবৃত্তি জাগ্রত করার জন্য হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) নির্বিঘ্ন ও সহজসাধ্য মাধ্যম হিসেবে সপ্ত–পদ্ধতিকে পরিচিত করেছেন। সপ্ত পদ্ধতি দুই স্তরে অনুশীলিত হয়।
ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর;
১) ফানা আনিল খাল্ক: পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করা।
২) ফানা আনিল হাওয়া: যা না হলেও চলে, এমন কাজকর্ম ও কথাবার্তা হতে বিরত থাকা।
৩) ফানা আনিল এরাদাঃ নিজ ইচ্ছা বাসনাকে খোদার ইচ্ছায় বিলীন করে তাছলিম ও রজা অর্জন করা।
মাউতে আরবা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু
৪) মউতে আবয়্যাজ বা সাদামৃত্যু: উপবাস ও সংযমের মাধ্যমে অর্জিত এই মৃত্যুতে মানব মনে উজ্জলতা ও আলো দেখা দেয়। রমজানের রোজা বা নফল রোজা ইত্যাদি উপবাস ও সংযম পদ্ধতি।
৫) মউতে আছওয়াদ বা কালোমৃত্যু: সমালোচনায় বিরক্ত বা রাগান্বিত না হয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজকে সংশোধনের মনমানসিকতা অর্জনই কালোমৃত্যু।
৬) মউতে আহমর বা লালমৃত্যু: কামস্পৃহা ও লোভ–লালসা হতে মুক্তিতে হাসিল হয়।
৭) মাউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যু: নির্বিলাস জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে সবুজ মৃত্যু লাভ হয়।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) এর উত্তরাধিকারীঃ হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) তার ওফাতের পূর্বে আপন নাতি হযরত শাহ সুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীকে (কঃ) বালেগ ঘোষণা করে মাইজভান্ডার দরবার শরীফে আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী নির্ধারন করে যান। হযরত কেবলা (কঃ) এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমার ‘দেলাময়না’ বালেগ। দেলাময়নাই আমার গদীতে বসবে।”
বর্তমান পীরে তরিকত ও সাজ্জাদানশীনঃ হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (কঃ) পীর হওয়ার জন্য খেলাফতপ্রাপ্ত হওয়ার শর্তের প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে যিনি আপন পীর সাহেবের কাছ থেকে সরাসরি ও স্পষ্টভাবে খেলাফত পাননি তিনি কোনভাবেই কাউকে বায়াত দেয়ার যোগ্য নন।
খেলাফত প্রদানপূর্বক সাজ্জাদানশীন মনোনয়নের মাধ্যমে গাউছিয়ত জারি রাখার নিয়মের অনুসরনে হযরত শাহ সুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীও (ক🙂 তার জীবিতাবস্থায় তদীয় তৃতীয় পুত্র হযরত শাহ সুফী সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারীকে (মঃ) নিজ গদীর উত্তরাধিকারী ও মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত করে যান।
তিনি শাহ সুফী সৈয়দ এমদাদুল হক (মঃ জিঃ আঃ) কে সাজ্জাদানশীনের দায়িত্ব অর্পনের বিষয়টি জরূরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও তার লিখিত ‘মানব সভ্যতা’ নামক বইয়ের ভুমিকাংশে উল্লেখের মাধ্যমে প্রামান্যকরন করেন।
‘মানব সভ্যতা’ বইয়ের ভুমিকাংশে তিনি উল্লেখ করেন, “অত্র বইটি আমার জীবন সায়াহ্নে ছাপাইয়া যাইতে পারিব কিনা ভবিতব্য খোদাই তাহা ভালো জানেন। তাই বইটি ছাপাইবার জন্য আমাদের প্রচলিত “আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী” সমাজ–সংস্কার ও নৈতিক উন্নয়ন মূলক সমাজ সংগঠক পদ্বতির সফলতার উদ্দেশ্যে হানেফী মজহাব এজমা ফতোয়ার ভিত্তিতে আমি যেইভাবে কামেল অলীউল্লাহর নির্দেশিত উত্তরাধিকারী গদীর সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত তদ্মতে আমার ছেলেদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি সৈয়দ এমদাদুল হক মিঞাকে “সাজ্জাদানশীন” মনোনীত করিবার পর এই গ্রন্থটি তাহার হস্তে অর্পণ করিলাম।”
সাজ্জাদানশীনের আধ্যাত্মিক অবস্থানের প্রতি শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীর (রহঃ) স্বীকৃতিঃ একদিন হযরত শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কঃ) তার পূর্ব বাড়ি থেকে গাউছিয়া আহমদীয়া মঞ্জিলে আসেন।
হযরত জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কঃ) আপন ছোট ভাই শাহ সূফী সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (মঃ) কে অছীয়ে গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (কঃ) এর চেয়ারে বসার জন্য বলেন।
মুর্শিদের প্রতি আদব রক্ষার্থে তিনি আপন মুর্শিদের চেয়ারে বসতে ইতস্ততঃ করতে থাকেন। কিন্তু বড়ভাই চেয়ারে বসার জন্য তাকে বারবার পীড়াপীড়ি করতে থাকেন।
একদিকে মুর্শিদের প্রতি সম্মান ও আদব রক্ষা অন্যদিকে বড় ভাইয়ের পীড়াপীড়ি– এহেন অবস্থায় তিনি উপস্থিত ভগ্নিপতিকে অনুরোধ করেন তার বাবা ও মুর্শিদকে পরিস্থিতি জানিয়ে দিক নির্দেশনা জানার জন্য।
হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (কঃ) ঘটনা শুনে তৎকালীন নায়েব সাজ্জাদানশীন হযরত সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (মঃ) কে তার চেয়ারে বসতে বলেন।
তখন তিনি চেয়ারে বসেন। হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কঃ) মোনাজাত করেন। এরপর খাদেমকে আদেশ করেন চেয়ারটি নিয়ে শাহী ময়দানের মাঝখানে রাখতে। খাদেম চেয়ারটিকে সেখানে নিয়ে রাখলে তিনি আবারও তাকে চেয়ারে বসতে বলেন। এবং মোনাজাত করেন।
হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (কঃ) এই ঘটনার রহস্য প্রকাশ করে বলেন, হযরত শাহ সূফী সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (মঃ) এর রূহানী উত্তরাধিকারকে হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কঃ) এই ধরনের রূপক কাজের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন।
মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারীদের প্রতি বর্তমান সাজ্জাদানশীনের দিক নির্দেশনাঃ বর্তমান সাজ্জাদানশীন হযরত সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (মঃ) আধ্যাত্মিক সাধনায় সফলতা লাভের জন্য শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোরারোপ করেন। তিনি বায়াত প্রদানকালে মুরীদদের সবসময় বলেন, “শরীয়তকে বাদ দিয়ে তরিকত নাই”।
তিনি বায়াত প্রদান কালে মুরীদদের প্রথম যে বিষয়ের জন্য বলেন তা হচ্ছে নিয়মিত নামাজ পড়া; রোযা রাখা; সামর্থ্য থাকলে হজ্ব–জাকাত আদায় করা অর্থ্যাৎ শরীয়ত পালন করা।
পরিশিষ্টঃ ইসলামী সভ্যতার বিকাশে তাসাউফ চর্চা ও তৎসংশ্লিষ্ট ধ্যান–ধারনার অবদান অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে সূফী তরিকাসমুহ ইসলামী চরিত্র গড়ার এক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাইজভাণ্ডারী তরিকা জনসমাজকে ধর্মের মূল সৌন্দর্য্য অবলোকন করিয়ে এর অর্ন্তনিহিত শক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে। এই কার্যক্রমে ইসলামী চরিত্র অর্জনে যেমন সাহায্য করা হচ্ছে তেমনিভাবে অন্যধর্মের অনুসারীদের সামনে ইসলামের প্রকৃত আহ্বান ও নীতি তুলে ধরার পথ উন্মোচিত হচ্ছে।