এম ডি এইচ রাজু, চট্টগ্রামঃ
‘মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ের বাদ্য আলা বাজে রে/ মালকার বিয়া হইলো মনু মিয়ার সাথে রে…’ গানটি শোনেননি এমন মানুষ বিরল। গানের কথায় যে দুজন মানুষের উল্লেখ, তাঁরা কারা? যাঁদের ইতিহাসের পাঠ আছে, তাঁরা জানেন মালকা বানু ও মনু মিয়ার উপাখ্যান। জানেন এই লোকগানের পেছনের কথাও।
আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা গ্রামে। মনু মিয়ার বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। মনু মিয়ার উদ্যোগে আনোয়ারায় নির্মিত স্থাপনা এখনো বহন করছে তাঁর ইতিহাস। এই গ্রামে মনু মিয়ার একটি মসজিদ আছে।
মোগল আমলের মসজিদটি সামনের দিকে কিছুটা সম্প্রসারণ করা হলেও মূল অবকাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে। ২০ ও ৪০ ফুট আয়তনের মসজিদের দেয়ালজুড়ে, ভেতরে–বাইরে চোখে পড়বে সুন্দর কারুকাজ আর গম্বুজ। মসজিদের প্রবেশপথে একটি ফলকে লেখা আছে, ‘মোগল আমলের শেষের দিকে জমিদার জবরদস্ত খাঁ (মনু মিয়া) এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রী খোরসা বানুর নামে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তাঁর আরেক স্ত্রী ছিলেন বাঁশখালীর সরল গ্রামের বিখ্যাত মালকা বানু। নির্মাণের পর থেকে এই মসজিদটি আর সংস্কার করা হয়নি।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও এর সৌন্দর্য বাড়াতে ১৪১৭ এবং খ্রিষ্টাব্দ ২০১০ সালে মসজিদটিতে টালি সংযোজন ও সংস্কার করে।’
চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থ দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস–এর তথ্যমতে, বাংলার সুবাদার মোগল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার (শাহজাদা সুজা) সেনাপতি ছিলেন শেরমস্ত খাঁ। আর শেরমস্ত খাঁর একমাত্র পুত্র জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া। মনু মিয়া প্রথমে বিয়ে করেন কাট্টলীর জমিদার দেওয়ান বদিউজ্জমানের বোন খোরসা বানুকে।
খোরসা বানুর কোনো সন্তান না হওয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল গ্রামের সওদাগরকন্যা মালকা বানুকে। মালকা বানুকে দেখা আর পরে তাঁকে বিয়ে করাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় লোকগাথা মালকা-মনুর প্রেম উপাখ্যান।
ইতিহাস গ্রন্থে আছে, মনু মিয়া একদিন পাইক-পেয়াদা নিয়ে জমিদারি দেখতে বাঁশখালীর সরল গ্রামে যান। সেখানে সওদাগর বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেন। ওই সময় মনু মিয়ার চোখে পড়ে সওদাগরের মেয়ে মালকা বানুকে। মালকা তখন কাজির মক্তবে পড়াশোনা করতেন।
তখন মনু মিয়া কাজির কাছ থেকে মালকা বানু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেন। কাজির মক্তবে মনু আরও একবার খুব কাছ থেকে দেখেন মালকাকে। এরপর মনুর নাওয়া-খাওয়া যেন বন্ধ হয়ে গেল। মনুর ভাবনায় শুধুই মালকা। মালকাকে চাই মনুর।
সেই থেকে মালকার টানে মালকা বানুর বাড়িতে ছুটে যেতেন মনু। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মালকা-মনুর প্রেমের কাহিনি। একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচবেন না। একদিন মনুর পক্ষ থেকে মক্তবের কাজির মাধ্যমে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব যায় সওদাগর বাড়িতে, মালকা বানুর বাবার কাছে। মালকার বাবাও মনুর প্রস্তাবে খুশি হলেন। তবে বেঁকে বসলেন মালকা।
তিনি শর্ত দিলেন, নদীপথে নৌকা পারাপারে তাঁর ভয় করে। তাই নিতে হবে সড়কপথে। এ কথা শোনার পর মনু দেরি না করে নদে বাঁধ দিয়ে সড়ক তৈরি করেই মালকাকে আনার সিদ্ধান্ত নেন। মনু শঙ্খ নদে বাঁধ দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন এবং হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেন নদে বাঁধ দেওয়ার জন্য।
বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন। মালকা এলেন মনুর ঘরে। মালকা-মনুর এই প্রেম ও বিয়ের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট লোকগীতি আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে।
ইতিহাসে আছে, মনু মিয়ার বাবা সেনাপতি শেরমস্ত খাঁ এক হাজার সৈনিকের অধিপতি ছিলেন। শক্তিশালী মোগল যুগের কামান, প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঘোড়া-হাতিসহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের সরঞ্জাম তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল বলে তাঁদের বাড়ির বাঁ ও ডান পাশে লস্কর ভিটে ও উজির ভিটে এবং হাজার সৈন্যের দুর্গকে কেন্দ্র করে বটতলী গ্রামের পূর্বে হাজারী দুর্গ বা হাজারীহাটের নামকরণ করা হয়।
১৯৮০ সালে মনু মিয়ার বাড়ির পশ্চিম পাশে থেকে প্রায় সাড়ে ২৭ মণ ওজনের মোগল যুগের একটি কামান উদ্ধারের পর শাহ সুজার সেনাপতি শেরমস্ত খাঁর তৎকালীন অবস্থান নিশ্চিত করে দেয়। কামানটি বর্তমানে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আছে।
মালকা বানুর গর্ভেও মনু মিয়ার ঔরসে কোনো সন্তান জন্ম নেয়নি। নিঃসন্তান মনু মিয়া মারা যাওয়ার পর পাশে কাজীর পাহাড় এলাকায় কবর দেওয়া হয়। মনুর মৃত্যুর পর প্রথম স্ত্রী খোরসা বানু স্বামীর বাড়িতে থেকে গেলেও বাঁশখালীর সরল গ্রামে বাবার বাড়ি চলে যান দ্বিতীয় স্ত্রী মালকা বানু।
মনু মিয়ার উত্তরাধিকার কেউ না থাকলেও মনু মিয়ার মসজিদ, কবরস্থান আর সুবিশাল দিঘি জানান দেয় ইতিহাস এ!