ড. ওবায়দুল করিমঃ
ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে গত ঊনবিংশ শতকে এক বিরাট বিতর্ক ছিলো। বিতর্ক তৈরি করে, ঐ সময়কালের রেডিক্যালরা। তাঁদের যুক্তির মোদ্দা কথাটা হলো, ইতিহাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তির কোন ভূমিকা নেই। যতটুকু আছে তা গতিপথের নিয়ন্ত্রণের ফল হিসেবে। ব্যক্তিসমাজ, সংগঠনের নির্ধারিত সামাজিক সম্পর্কের পাত্র-পাত্রী মাত্র। সামাজিক পরিবর্তন, ইতিহাসের ঘটনাক্রমে মানুষের ইচ্ছামুক্ত। ফলে সামাজিক ঘটনাসমূহের নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ। এই ছিলোই ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক যান্ত্রিক ব্যাখ্যার ফল।
বাস্তবটা হলো ভিন্ন। পাত্র-পাত্রীর মিথস্ক্রিয়ায়(ওহঃবৎধপঃরড়হং) তৈরি হয়-সমাজ, সামাজিক সম্পর্ক। সমাজ তৈরি হয় যখন, তখনই তৈরি হয় ক্ষমতার বিভাজনের। কেউ হোন নেতা, কেউ হোন সাধারণ সভ্য। নেতা আর সভ্য্থর ভেতরে ফারাকটা হলো ব্যক্তির ভূমিকা। ভূমিকা নির্ধারিত হয়, ব্যক্তির যোগ্যতা ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে। আর এই যোগ্যতা ও সামর্থ্যের পার্থক্য সমাজের সবক্ষেত্রেই স্তরায়িত করেছে।
স্তরায়ন যখন বঞ্চনা ও শোষণের উপায় হয় তা কাম্য নয়, কিন্তু যোগ্যতা ও সামর্থ্যের বিবেচনায় সমাজের প্রগতির উপায় হলে তা, অতি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য, কারণ কোনো প্রাণী, গাড়ী এক পা বা এক চাকায় চলেনা। সমাজের অগ্রগতি ও কোনো এক পেশাজীবীর ভূমিকায় পরিবর্তন হয় না। সব পেশায় থাকে নেতৃত্ব। নেতৃত্ব সমাজ ও সংগঠনের ভিত্তি।
ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা নিষ্ক্রিয় নয়, বরং সক্রিয়তাই পরিবর্তনের উৎস। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়, উৎপাদন ও বণ্টনের ভিত্তিতে। সমাজে উৎপাদন ও বণ্টনের বিষয় না থাকলে, সমাজ তৈরি হতো না। আগুনের আবিষ্কার মানুষকে উৎপাদনের উপায় তৈরিতে সাহায্য করে, সাহায্য করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে। উৎপাদনের উপায়ের উন্নয়ন সামাজিক সম্পর্কের মাত্রাকে নির্ধারণ করে। বলা হয়, উৎপাদনের উপায় উন্নয়নের একটা মুহূর্তে পুরোনো সামাজিক সম্পর্ক বহাল থাকলে আর এগুতে পারে না। প্রয়োজন হয়, পুরোনো সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তনের। আর এই পরিবর্তনে প্রয়োজন প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্বের।
প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব যখন, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, এবং এর ফলে জনগণের ভূমিকায় এক সামাজিক সম্পর্ক পরিবর্তনের সূচনা করে। ফলে বদলে যায়, উৎপাদন ব্যবস্থা বা ভিত্তিভূমির। আর এই পরিবর্তন নিয়ে আসে মানুষের নয়া চিন্তা, বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণার। স্মর্তব্য ব্যক্তির ভূমিকা এখানে অন্যতম এবং অবশ্যম্ভাবী। যথেষ্ট উদাহরণ নয়, শুধু একটি উদাহরণের উল্লেখই যথেষ্ট।
মধ্যযুগে ইউরোপে ছিলো সামন্তযুগ বা ভূমিদাস ব্যবস্থা। ভূমিদাসরা ছিল ভূমির দাস। দাসদের এবং তাদের উত্তরসূরীদের আজীবন ভূমিতে শ্রম প্রয়োগ নির্ভর জীবন ছিলো। এই ছিলো, সামাজিক সম্পর্ক। ঐ সময়কালে ইংল্যান্ডে ও ইউরোপের অন্যান্য স্থানে একটি পুঁজি নির্ভর মার্চেন্ট বা ব্যবসায়ী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। নয়া প্রযুক্তির উদ্ভাবন বা উৎপাদনের নতুন উপায় নয়া সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করে।
এই সামাজিক সম্পর্ক হলো পুঁজির মালিক ও শ্রমশক্তি বিক্রয় নির্ভর শ্রমিকের সম্পর্ক। কিন্তু ভূমিদাস সামাজিক সম্পর্ক, এই নয়া সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পনির্ভর নয়া উৎপাদনের উপায় বা শিল্পায়ন বিকশিত হতে পারছিলো না ভূমিদাস সামাজিক সম্পর্ক বা প্রথার কারণে। একে বদলানো উৎপাদনের নয়া শক্তির বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু মানুষেরা ভূমিদাস প্রথাকে স্বাভাবিক মনে করছিলেন। তখনকার সামাজিক বিশ্বাস ছিলো, রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। রাজা যা করেন ঈশ্বরের নির্দেশেই করেন।
সুতরাং রাজ নির্দেশের বিরোধিতা, ঈশ্বরের বিরোধীতাকেই বোঝায়। প্রজারা এও বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি। এই বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষকে বুঁদ মুক্ত করা না হলে, নয়া সামাজিক বিপ্লব বা সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বেরিয়ে এলেন হবস, লক, রুশোসহ অনেকেই। বললেন, জনগণের ইচ্ছাতেই রাষ্টের সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের চুক্তি, রাষ্ট্রনামক কর্তৃত্বের সৃষ্টি করেছে, সুতরাং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন রাষ্ট্রের কাজে না থাকলে, একে পরিবর্তনের সুযোগ দিতে হবে। রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি তাও সঠিক নয়। জনগণ বিশেষ করে ভূমিদাসদের এই নয়া ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবস, লক এবং রুশোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
শুধু উৎপাদিকা শক্তি বা উৎপাদনের উপায়ের উন্নয়নই নয়, সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব ও উদ্বুদ্ধকরণ বিশেষভাবে প্রয়োজন। পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভবে বাজারের শক্তির (গধৎশবঃ ঋড়ৎপবং) এর স্বাধীনতা দরকার ছিলো, আর এর বাস্তবায়নে দরকার রাজনৈতিক স্বাধীনতার। হবস, লক, রুশো বললেন গণতন্ত্রের কথা। অর্থনীতির প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।
এই বিশাল পরিবর্তনে এঁদের ভূমিকা ছাড়া শিল্পসমাজে উল্লম্ফন সম্ভব ছিলো? দাস ব্যবস্থার পরিবর্তন হলো, অথচ স্পার্টাকাস নেই, তা কি হয়? রোবসপিয়র নেই, অথচ হলো ফরাসি বিপ্লব? নেই লেনিন, সম্ভব রুশ বিপ্লবের? মাও সে তুং নেই, কল্পনা করা যায় আধুনিক চীনের? চিন্তা করা যায়, হো চি মিন নেই, অথচ দাঁড়িয়ে আছে, আধুনিক অগ্রসরমান ভিয়েতনাম? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নেই, আধুনিক বাংলাদেশের? অসাধারণ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ইতিহাসের প্রতি ঘটনায় দেখা যায়। ব্যক্তি, অসাধারণ ব্যক্তির ভূমিকা তাই ইতিহাসের ঘটনাবলির উৎস। তাই চিন্তার অস্তিত্ব সামাজিক পরিবর্তনের উপায়। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিও তাই প্রয়োজনীয়।
সমাজের অনেক ঘটনাই আমাদের ইচ্ছা নিরপেক্ষ। আমাদের ইচ্ছার উপর সামাজিক ঘটনা সমূহ সকল সময়েই নির্ভরশীল নয়। সামাজিক ঘটনা ঘটবার কারণ সমূহ ঝড়পরধষ উুহধসরপং বুঝবার সামর্থ্যের সাথে জড়িত। তবে ব্যক্তিত্ববান, যোগ্যতা ও সামর্থ্য রাখেন এমন ব্যক্তি তা অনুধাবন করেন ও সামাজিক গতিবিদ্যার ভবিতব্য অনুধাবন করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এঁরাই হয়ে উঠেন নেতা, বিজ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান দার্শনিক। বিজ্ঞানী না থাকলে, সমাজ বদলায়? নেতৃত্ব না থাকলেও সমাজ বদলায় না।
যে কোনো সামাজিক ঘটনা ঘটবার কালের পেছনে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়াকাল থাকে। ইউরোপে ভূমিদাস প্রথা হাজার বছরের উপরে টিকেছিলো। তবে ম্যাগনাকার্টার সনদের ঘোষণার সাথে সাথেই, মানবাধিকারও গণতন্ত্রের সূচনা করেনি। রমহরঃরড়হ বা প্রজ্জলনটা তখন শুরু হলেও, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ভোক্তা অধিকার ইত্যাদির স্বীকৃতির আরো সময় লেগেছিলো।
সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি, মনে করতেন দ্বাদশ শতকের ঘোষিত ম্যাগনাকার্টার সনদ তখনই বাস্তবায়ন করতেই হবে, তাহলে তা হতো, ঘোড়ার আগে গাড়ী লাগানোর সামিল। লোহা তপ্ত হয়ে প্রচণ্ড লাল রং ধারণ করলেই, তাকে বাঁকানো যায়। তার আগেই বাঁকানোর চেষ্টা, রাজনীতির ভাষায় একে হঠকারিতা বলে। রেডিক্যাল রাজনীতির পরিভাষায় বলা হতো, ‘ঈড়হপৎবঃব ধহধষুংরং ড়ভ পড়হপৎবঃব ংরঃঁধঃরড়হ’ বা ‘বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষ’ করতে পারাটাই রাজনীতিতে সফল হওয়ার মাপকাঠি।
এই অবস্থাকেই একাডেমিক ভাষায় বললে, বলতে হয়, ঙনলবপঃরাব ঈড়হফরঃরড়হ বা বিষয়গত শর্ত ও ঝঁনলবপঃরাব ঈড়হফরঃরড়হ বা বিষয়ীগত শর্ত। যখন কোনো কিছু পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত তখন তা বিষয়গত শর্ত এবং জনগণও বা বাইরের শর্তসমূহও পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত, কেবল তখনই পরিবর্তনের জন্য মানুষের ক্রিয়া প্রয়োজন। আর প্রয়োজন একে অনুধাবন করতে পারেন এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের। এই শর্তগুলোর অনুপস্থিতি, কোনো উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বজাত্যবোধ ১৯৪৭ এ পাকিস্তান সৃষ্টির পররাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে উৎসারিত।
সময় একটি বড় মাত্রা এখানে। ১৯৪৮ থেকে বাংলা ভাষার উপর আঘাত, এই প্রতীতি জন্মায়, যে সংখ্যা গরিষ্ঠতা এখানে উপেক্ষিত। পরে উপলব্ধিতে আসে, এতদ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। গণতন্ত্র উপেক্ষিত হবে, তা সৃষ্টিকালের ঘটনাক্রমের পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট।
পাকিস্তানের সরকারি চাকুরেদের তৎকালীন দুই অংশের তুলনা করলে ভেদনীতি স্পষ্ট হয়। একটি সংবিধান দিতে পারেনি ১৯৫৬ এর আগে তাও পরিত্যক্ত হয় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই অল্প সময়কালটাও বঙ্গবন্ধুর মানসপট গঠনে ভূমিকা রাখে। এই কথা আমরা বলে থাকি, রবীন্দ্রনাথ যদি এই কালে জন্ম নিতেন, তাহলে তিনি ‘ঘরে বাইরে’, ‘শেষের কবিতা’ লিখতে পারতেন না। কারণ ‘ঘরে বাইরে’ লিখবার সামাজিক কন্টেক্সটটা এখননেই। হয়তো আরো মহৎ কিছু লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ কলম দিয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ক্রিয়ার মাধ্যমে এমনকি কলমে, সম্প্রতি যা প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানের একটা দায়িত্ব হলো, প্রকৃতির নিয়মকে জানা এবং সে নিয়মকে প্রয়োগ করে প্রকৃতিকে বদলানো। এই-ই হলো মানবজাতির সভ্যতার বিকাশের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু সামাজিক ঘটনা প্রবাহকে বোধে আনতেন, এবং সামাজিক ঘটনা প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাস্তব অবস্থার, বাস্তব বিশ্লেষণ বোধ ছিলো তাঁর প্রখর। বাংলাদেশের রেডিক্যাল চিন্তায় যখন, রণনীতি, রণ-কৌশল, বিষয়গত ও বিষয়ীগত অবস্থা নিয়ে বিতর্ক চলছে, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক জার্গন (চড়ষরঃরপধষ ঔধৎমড়হ) বা ঢ়ড়ষরঃরপধষ পষরপযব নয়, জনগণের ভাষায় জনগণের সাথে যোগাযোগ করতেন।
এদেশে বাম প্রগতির পক্ষের শক্তিগুলো যখন রুশ-চীন রাজনৈতিক বিভক্তি হয়, এরপরে কিছু চীনাপন্থী পক্ষ, বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) পাকিস্তানের উপনিবেশ, আধা-উপনিবেশ, জাতিগত নিপীড়ন, আধা-সামন্তবাদ ইত্যাদি বিতর্কে কালক্ষেপণ আর নিজেদের বিভক্তি বাড়াচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু জনগণের ভাষায়, পূব আর পশ্চিমের বৈষম্য বোঝাচ্ছিলেন। বোঝাচ্ছিলেন সাংস্কৃতিক নিপীড়নের কথা। বাম মার্গে এমন সহজ ভাষায় জনগণের সাথে যোগাযোগের উপায় ছিলোনা।
প্রধান দ্বন্দ্ব ও অপ্রধান দ্বন্দ্ব নিরুপন করতে গিয়ে ঔধৎমড়হ ডধৎ ছাড়া বামপন্থীরা আর কিছুই করতে পারেননি। অথচ ঐ কালের পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তানের উপনিবেশ কিনা, সমাজকাঠামো আধা-ঔপনিবেশিক কিনা এ বিতর্কে না গিয়েও, সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষার ব্যবহারে জনগণের দোরে পৌঁছুনো যেতো। বঙ্গবন্ধু শুধু শব্দ দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বৈষম্যের শিকার। এই বোধের অনুরণনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার স্ফুরণ ঘটে।
আওয়ামী লীগ ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে, এই ভাঙ্গনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর কাছে, বৈদেশিক নীতির আবেদন জনগণের কাছে প্রধান হয়? পন্থীনির্ভর রাজনীতি, দেশের অভ্যন্তরীণ ংড়পরধষ ফুহধসরপং বুঝতে দেয় না। যখন দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় নিপীড়ন থেকে মুক্তিলাভ প্রধান তখন গৌণ কারণকে মুখ্য ভূমিকায় নিয়ে আসা সমীচীন? বঙ্গবন্ধু এইসব বিভ্রান্তিকে দূরে সরিয়ে বাঙালি জাতীয়তবাদী আন্দোলনের গতিটাকে সচল রাখতে পেরেছিলেন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ পাকিস্তানের পূর্ব অংশের নিরাপত্তা যে পাকিস্তানী শাসকদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয় তা উপলব্ধিতে আসে, তখনকার এতদ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কাছে। বঙ্গবন্ধুর নজরে এ বিষয়টিও এসেছে যথার্থ প্রয়োজনে। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা থাকলেও, পাকিস্তান একটি এক কেন্দ্রিক সরকারের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় পতিত হয়। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালি জাতিসত্তা নয়, এক ইউনিটের বাতিলের দাবি করে মূলত পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের বালুচ, পাঠান, সিন্ধু জাতিসত্তার উন্মেষ চাইছিলেন। এক ইউনিট প্রথা বাতিলের দাবি তাই প্রমাণ করে। উগ্র জাতীয়তবাদী বা শভিনিজম নয়, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদের ধারণা যা দেশসমূহের মুক্তি সংগ্রামকে যুক্ত করে, তাতেই তাঁর বিশ্বাস ছিলো।
৬ দফায় ছিলো এক অভাবনীয় ফেডারেশনের প্রস্তাব, যা শিথিল বা কনফেডারেশনেও খুব প্রতিভাত হয় না। প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নে ১৫টি অঙ্গরাজ্যের স্বকীয় পতাকা এবং ফেডারেশন থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থাকলেও, প্রতি রাজ্যের জন্য পৃথকমুদ্রার ব্যবস্থা বা আলাদা স্ট্যাট ব্যাংকের ধারণা ছিলো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই।
এছাড়া এর বিকল্প হিসেবে সহজে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা তবে তা কোনোভাবেই পাকিস্তানের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশে পাচার হতে পারবে না, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকলেও, দুই অঞ্চলে দুইটি স্ট্যাট রিজার্ভ ব্যাংক থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু এমন দাবী মূলত স্বাধীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করে। এক ইউনিট প্রথা ও দুই অংশের সংখ্যা সাম্য ছিলো অগণতান্ত্রিক। এই ব্যবস্থার রদের দাবী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবারই নামান্তর। পাকিস্তানে যেমন নয় বছর লেগে ছিলো শুধু একটি সংবিধান প্রণয়নে, ঠিক তেমনি সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। এর পেছনে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার ভূমিকাউল্লেখযোগ্য।
১৯৭০ এর সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন যা টহরাবৎংধষ ঝঁভভৎধমব এর ধারণা এর বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের ফসল ছিলো, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।খাজনা আদায়ে স্ট্যাট সমূহের হাতে ন্যস্ত করবার বিষয়সহ প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন মূলত স্বাধীনতার নকশাই ছিল। লাহোর প্রস্তাবের উৎস ধরে স্বাধীনতার এক মহাপরিকল্পনা এই ৬ দফাতে বিবৃত ছিলো। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন, বঙ্গবন্ধু। এইজন্য একে যে মুক্তির মহাসনদ বলা হতো, তা যথার্থই ছিলো।
বঙ্গবন্ধুর সাথে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ছিলো অত্যন্ত মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীকে শ্রদ্ধা করতেন, মাওলানা ভাসানীও বঙ্গবন্ধুকে স্নেহ করতেন। রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও, এই সম্পর্ক কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
১৯৭০ সালের নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, গৃহহীন হয়ে পড়ে তার চেয়েও বেশি। এমন অবস্থায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বই সহানুভূতি জানাতেও দুর্গত এলাকা ভ্রমণ করেনি। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, হেলিকপ্টারে করে একটা এরিয়াল ভিউ দেন মাত্র। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ইয়াহিয়ার বাংলার মানুষের সাথে এহেন অমানবিক আচরণের উপর এক অসাধারণ কবিতাও লেখেন।
এই ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে, বিভিন্ন বাম সংগঠনগুলো নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচন বর্জনের ডাক ছিলো, এঁদের। বঙ্গবন্ধু জানতেন , বিষয়ীগতভাবে জাতিকে প্রস্তুত করতে নির্বাচনে জন রায় এক মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। ঘূর্ণিঝড় ও এর পরবর্তী পাকিস্তানী শাসকদের এতদঞ্চলের মানুষের প্রতি আচরণ ও এর প্রতিক্রিয়া যে নির্বাচনে পড়বে, তা বঙ্গবন্ধু যথার্থ ভাবেই অনুভব করেছিলেন। নির্বাচনে অংশ গ্রহণের বিষয়টা এমন হয়েছিলো যে, ‘ভাতের জন্যই ভোট চাই’।
এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু’র অংশ গ্রহণ ছিলো, সময়োপযোগী। একাডেমিক ভাষায় এই সিদ্ধান্ত ছিলো,‘ঈড়হপৎবঃব ধহধষুংরং ড়ভ ঃযব পড়হপৎবঃব ংরঃঁধঃরড়হ’; নির্বাচন যদি না হতো, বাঙালির রায় যে, বিষয়ীগতভাবে বাংঁনলবপঃরাবষু পরিণত তা জানবার আর কোনো উপায়ই ছিলো না। এছাড়া সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার খবমধষ ঋৎধসবড়িৎশ ঙৎফবৎ(খঋঙ) মেনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচায়ক। একটা প্রচলিত কথা আছে, ‘শৃঙ্খলিত অবস্থায় শৃঙ্খলমুক্তির গান গাইতে হয়’; বঙ্গবন্ধু বাংলার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য, শৃঙ্খলের মাঝেই সংগ্রাম ও বিপ্লবের জন্যজনসাধারণকে প্রস্তুত করলেন।
পরবর্তীকালে এই প্রযুক্তির ফল দেখি, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে। তাঁর নির্দেশেই, পুরো প্রশাসন চলেছিল। ১৯৭০এর নির্বাচন যদি না হতো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জি হয়তো বিলম্বিত হতো। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পারা, রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বড় উপায়। জাতীয়তবাদী আন্দোলনের সময়, সমাজতন্ত্রের ইস্যু নয়, বরং জাতিসত্তার মুক্তি সংগ্রামটাই প্রধান।
পাকিস্তানের ফেডারেলিজমের দাবি নিয়ে, স্বাধীনতায় পৌঁছে দেয়ার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁর। রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান তৈরি করে। তাই রাজনৈতিক সংগ্রামের গুরুত্ব বঙ্গবন্ধু যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করেন। এবং স্বাধীনতার পরে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এর প্রয়োগ ও অর্জনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার তাঁর মাঝে দেখতে পাই।
প্রতি ব্যক্তিরই থাকে পরিচিতি। জৈবিক পরিচিতি যেমন, পিতা, সন্তান, ইত্যাদি। পিতা পরিচিতির সাথে সাথে সমাজ পিতা হিসেবে কিছু দায়িত্ব পালন করতে বলে। আবার মানুষের সামাজিক পরিচিতিও থাকে। যেমন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ। এগুলো সামাজিকভাবে অর্জিত, জৈবিক নয়। তবে সমাজ এখানেও পরিচিতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে বলে।
যেমন, যদি শিক্ষক হয়, তাহলে ছাত্রদের বিদ্যা বিতরণ করতে হবে। এই ভূমিকা ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপায়। তবে কিছু ব্যক্তিত্ব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সামাজিক পরিচিতি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই জাতির জনক পরিচিতি অর্জন করেন। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা শুধুমাত্র, ব্যক্তিকে অসামান্যব্যক্তিত্বে পরিণত করে তা নয়, ইতিহাসের গতিপথ, সমাজের আদলকেও নিয়ন্ত্রণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, সমাজতত্ত্বে ব্যক্তির ভূমিকার এক তাত্বিক ধারণার প্রতিষ্ঠায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।