স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশ। এই স্বাধীনতা অর্জনের যে ইতিহাস, তার পাতায় পাতায় রক্ত। রক্তের নদী বেয়ে আমাদের দেশের কূলে ভিড়েছে লাল সবুজের পতাকাটি। যাঁদের চোখে দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন ছিলো, তাঁরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কেউ প্রত্যক্ষভাবে, কেউ পরোক্ষে।
রণাঙ্গনে দেশকে মুক্ত করতে যাঁরা দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে, জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। ১৯৬২ সালে ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে আসেন। এরপর ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ও বিপ্লবী পরিষদ / নিউক্লিয়াসের সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, পাহাড়তলীর বিশাল এলাকাসহ চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন তাঁর সাথীদের নিয়ে। তান্দুয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে বিএলএফ কেসি তিন দলনেতা হিসেবে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, গেরিলা অপারেশনের নিয়ম ছিলো হিট এন্ড রান। তার মানে, হিট করেই ওখান থেকে সরে যেতে হবে।
পেছনে কী হলো না হলো সেটা দেখার সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম শহরে অনেকগুলো গ্রুপ ছিলো। এই গ্রুপগুলো ছিলো ট্রেনিং দেয়া। যৌথ কমান্ডার হলেও অপারেশনগুলো হতো গ্রুপ লিডারের নেতৃত্বে। বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন অপারেশন আছে।
সবগুলোই কিন্তু চট্টগ্রাম সিটির অঘোষিত নেগোসিয়েশনে হয়েছে। ডা. মাহফুজুর রহমানের দায়িত্ব ছিলো বিস্ফোরণ এবং গোয়েন্দা। এরমধ্যে একটি বড়ো অপারেশন ছিলো একদিনে একসাথে একশটা বিস্ফোরণ ঘটানো। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, একদিনে ভোর ৫টায় একই সাথে একশোটা বিস্ফোরণের প্রোগ্রাম নেয়া হয়েছিলো। সময়টা নভেম্বর ৩০ অথবা ডিসেম্বরের ১ তারিখ হবে। কিন্তু পাঁচলাইশে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন মুস্তাফিজ, সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার কারণে পঁচাশিটা বিস্ফোরণ ঘটাই। অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পর আমরা চলে গেলাম ঈদগাহ। সেখানে আমার একটা শেল্টার ছিলো।
আরেকটি অপারেশন ছিলো ফয়েজলেক টাওয়ার ফেলে দেয়া। তাঁর ভাষায়, ফয়েজলেকের অপারেশন ছিলো ফয়েজলেক বিহারি পাড়ার ভেতরে। এটি জয়েন্ট অপারেশন। হারুন ভাইয়ের কমান্ডে আমি গেছি। যদিও উনিও কমান্ডার আমিও কমান্ডার। তাঁর সাহসটা খুব বেশি ছিলো। আমাকে বললেন, আপনি কমান্ডার আমি অর্গানাইজার। সত্তর আশি জন যোদ্ধাকে নিয়ে যেতে হবে অপারেশনের জন্য। এটি একটি বড়ো অপারেশন। মজার কথা হলো, মশার কয়েল দিয়ে আমরা টাইমার বানিয়েছি।
টাওয়ার ফেলে দেয়ার জন্য একঘণ্টা বা দশ মিনিট পরে ফিউজটাতে আগুন ধরবে, হারুন ভাই বললেন, মশার কয়েল দিয়ে দেখতে পারো। হারুন ভাইয়ের বুদ্ধি ভালো। উনি সারারাত মশার কয়েল নিয়ে গবেষণা করে একদম নির্দিষ্ট সময়টা পিন আপ করে এসেছেন। এসে কয়েল ধরিয়ে ফিউজে লাগানোর পর আমরা এক একদিকে সরে গেলাম। আমি গেছি পাঞ্জাবি লেইনের দিকে। ওটা ছিলো রমজান মাস।
ফজরের নামাজ শুরু হবে এমন সময়। মুসল্লিরা ডাকাত মনে করে আমাদের ঘেরাও করে ফেলছে। ছোটোকাল ঐ এলাকায় কাটানোর কারণে একজন আমাকে চিনলেন। বললেন, মাহফুজ তুমি এখানে? পরে বললেন, ও আচ্ছা বুঝছি। এরপর তাঁরা আমাদের গোটা ব্যাটেলিয়নকে ঘেরাও করে প্রটেকশন দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম রেললাইন পর্যন্ত আমাদের পৌঁছিয়ে দিলেন।
ভোর পাঁচটা কিংবা রাত তিনটায় বিস্ফোরণ হলে অনেক দূরে থেকে শোনা যেতো। শহর এতো বড়ো ছিলোনা তখন। সেটিও একটি সফল অপারেশন।
চট্টগ্রাম শহরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন সম্পন্ন হয়েছিলো আজিজ গ্রুপের রাইসুল হক বাহারের নেতৃত্বে। চট্টগ্রাম শহরে এটিই একমাত্র ট্রেন অপারেশন। কৈবল্যধাম ট্রেন অপারেশন। ডা. মাহফুজুর রহমানে তথ্যসূত্রে পাওয়া এই অপারেশনের দিন ঠিক হয় ২৯ অক্টোবর, শুক্রবার। এ দিন হাটবার।
কাট্টলীর মানুষ বাজার করতে কর্নেল হাটে যায়। ফতেহ মোহাম্মদ চৌধুরী পাড়ার রুহুল আমিনের দেউড়িকে অপারেশনের আগমন কেন্দ্র হিসেবে ঠিক করা হয়। এ দেউড়ি এখানকার মুক্তিদের শেল্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। হিট গ্রুপের সদস্যরা এখানে বিকেল পাঁচটা থেকে জড়ো হতে শুরু করে। বোমা তৈরির বিস্ফোরক সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁরা যখন অপারেশন স্থলে যাত্রা শুরু করেন তখন রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে।
দু এক মিনিটের ব্যবধানে তাঁরা বাজারের থলে হাতে অপারেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কৈবল্যধাম ব্রিজ, কৈবল্যধাম আশ্রমের পশ্চিম পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের সিকি মাইল উত্তরে। বাহার কৈবল্যধাম ব্রিজের উপর চলে যাওয়া রেলবিটে পাশাপাশি দু’টি কাটিং চার্জ বসান। ব্রীজের নিচে কোনো পিলার না থাকায় তিনি সেতুর উপর রেল বিটের পাশে বিস্ফোরক বসিয়ে দু’টি কাটিং চার্জ তৈরি করেন।
কৈবল্যধাম ব্রিজ ধ্বংসের জন্য বাহার ব্যবহার করেছেন টিএনটি স্ল্যাব। রেল বিটে তিনি দু’টি কাটিং চার্জে তিনটি করে মোট ছয়টি টিএনটি স্ল্যাব বসান। বিটের একপাশে দু’টি ও অন্যপাশে একটি করে টিএনটি স্ল্যাব বসিয়ে তিনি দুটি কাটিং চার্জ তৈরি করেন। গেরিলাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গেরিলাদের হামলার আশঙ্কায় ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য রেলওয়ে কতৃপক্ষ সবসময় ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে দু’টি খালি বগি জুড়ে দিতো।
মিলিটারিদের রসদবাহী এই ট্রেনেও একই ব্যবস্থা। বাহারের উদ্দেশ্য ছিলো এই অপারেশনের মাধ্যমে ট্রেনের বগি নয় ইঞ্জিনেরই ক্ষতি করা। কারণ বগির চেয়ে ইঞ্জিনের মূল্য ও প্রয়োজন অনেক বেশি। তাই তিনি বোমার উপর দিয়ে ইঞ্জিনের সামনের বগি অতিক্রমের সময় চার্জ এর সেফটিপিন মুক্ত না করে ইঞ্জিন যাওয়ার সময়ই দড়ি টেনে চার্জ এর সেফটিপিন মুক্ত করেন। ব্রীজের নিচের অংশ ফাঁকা থাকায় এ বিস্ফোরণ থেকে উর্ধ্ব ও নিম্নমুখী প্রচন্ড কোনো বায়ুচাপ সৃষ্টি করতে পারেনি।
কিন্তু রেলবিট দু’পাশে আঁকাবাঁকা হয়ে সরে যাওয়ায় ব্রিজের স্লিপারগুলো নিচের দিকে ছিটকে পড়ে যায়। ট্রেনটির স্টিম ইঞ্জিনের ভার চাকার উপর বহন করার মতো ব্রীজের মাঝে কোনো যথাস্থানে না থাকায় ইঞ্জিনটির সামনের দিক লাইনচ্যুত হয়ে খাদের উপর আটকে যায়। অনতিদীর্ঘ ট্রেনটির ইঞ্জিনের পেছনের দু’টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে কাত হয়ে যায়। এ অপারেশনে রসদবাহী ট্রেন ও রেলওয়ের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও শত্রুবাহিনীর মনোজগতের ভিতে অনেকগুণ বেশি অমোচনীয় ধ্বংসলীলা চালায়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান তাঁর কথায় বারবার এদেশের জনগণের সহায়তার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ আমরা করেছি। কিন্তু আমাদের সাহস হয়ে পাশে ছিলেন এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষগুলো। তাঁরাই প্রকৃতযোদ্ধা।’ বিজয়ের মাসে প্রত্যেক শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
শ্রদ্ধা জানাই সে সব অনন্য সাধারণ মানুষকে যাঁরা দেশের স্বার্থে সহ্য করেছেন পাকিস্তানি সেনাদের অমানবিক অত্যাচার।