ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায় ।। ১১ বছরের সাজা, তিনি আছেন কানাডায়
চট্টগ্রামের সময় ডেস্কঃ
ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দুটি ধারায় ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। গত চার বছর ধরে বিদেশে অবস্থানরত এসকে সিনহাই বাংলাদেশের প্রথম সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি দুর্নীতিতে দোষী সাব্যস্ত হলেন।
ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) এই ঋণ আত্মসাতের মামলার ১১ আসামির মধ্যে আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত, খালাস পেয়েছেন দুজন। ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালত বিচারক শেখ নাজমুল আলম গতকাল মঙ্গলবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
১৮২ পৃষ্ঠার এই রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ফার্মার্স ব্যাংকের যে ক্রেডিট পলিসি রয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে তা লঙ্ঘন করে সাবেক প্রধান বিচারপতির জন্য ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল। সেই অর্থ যে পাচার হয়েছিল, সেটাও এ মামলায় প্রমাণিত হয়েছে। দুটি ধারায় কারাদণ্ডের পাশাপাশি এস কে সিনহাকে ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সেই অর্থ না দিলে তার সাজা আরও ছয় মাস বাড়বে। এছাড়া তার অ্যাকাউন্টে অবরুদ্ধ থাকা ৭৮ লাখ টাকা বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে। পলাতক থাকায় এ মামলায় এস কে সিনহার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। অন্য আসামিদের আইনজীবী মো. শাহীনুর ইসলাম অনি রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, কোনো ভায়োলেশন ছিল না…।
পূর্ণাঙ্গ আইন মেনেই সবকিছু করা হয়েছে। দুজন গ্রাহককে ইতোমধ্যে খালাস দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ গ্রাহক ভুয়া না। এখানে ভুয়া কোনো গ্রাহক ছিল না। যে পরিমাণ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তার অধিকাংশই আবৃত আছে ঋণের সিকিউরিটি হিসাবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য আবেদন করা হবে বলে জানান তিনি।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে নজিরবিহীন টানাপড়েনের মধ্যে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এস কে সিনহা। আর কখনও কোনো প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ বাংলাদেশ দেখেনি। পদত্যাগের চার বছর পূর্ণ হওয়ার ঠিক দুদিন আগে আত্মসাতের এ মামলায় তার সাজার রায় এল, যে অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে আসছেন।
এস কে সিনহা বিদেশে যাওয়ার দুই বছর পর এ মামলা দায়ের করেছিল দুদক। এরপর গত বছর ১৩ আগস্ট ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। এসকে সিনহাকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে।
কার কেমন সাজা : এ মামলার প্রধান আসামি এসকে সিনহার ১১ বছরের কারাদণ্ডের রায় এসেছে দুটি ধারায়। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের দায়ে তার ৪ বছরের সাজা হয়েছে। আর মানি লন্ডারিংয়ের ধারায় দেওয়া হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড। অবশ্য আত্মসমর্পণ করলে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন তিনি।
আসামিদের মধ্যে টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান এবং একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহাকে খালাস দিয়েছে আদালত। তাদের নামে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলেই ঋণ নেওয়া হয় এবং পরে তা সরানো হয় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে।
জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ আত্মসাতে ‘সহযোগিতার’ জন্য ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীমকে দেওয়া হয়েছে চার বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতীর (বাবুল চিশতী), ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা রনজিৎ চন্দ্র সাহা এবং তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়কে দেওয়া হয়েছে তিন বছর করে কারাদণ্ড। এই ১১ আসামির মধ্যে শুধু বাবুল চিশতী কারাগারে ছিলেন।
রায়ের আগে তাকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা শামীম, স্বপন, লুৎফুল হক, সালাহউদ্দিন ছিলেন জামিনে। তারাও আদালতে হাজির ছিলেন। এছাড়া এস কে সিনহার মতো সাফিউদ্দিন, রনজিৎ ও তার স্ত্রীকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে।
অভিযোগ কী ছিল : নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা তিন বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
বিচারপতির বিচার : দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালত ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২১ জন সাক্ষীর সবার সাক্ষ্য শোনে আদালত, তাদের মধ্যে এস কে সিনহার আপন বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং মামাতো ভাইয়ের ছেলে শঙ্খজিৎ সিনহাও রয়েছেন।
এস কে সিনহা কোথায় : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন।
তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলেন এস কে সিনহা। নিউ জার্সিতে ছোট ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে কেনা একটি বাড়িতে সে সময় তিনি থাকছিলেন। পরে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে খবর আসে সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।
বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।