কর্ণফূলীর তীর দখল
দখলে দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলীতে এক মাসের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। ঢাকার বুড়িগঙ্গা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে একই সাথে বড় পরিসরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কর্ণফুলীতে দখল এবং দূষণ চলছে বহুদিন ধরে। নদী দখল করে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরণের অবকাঠামো। পাকা, আধা পাকা, কাঁচা স্থাপনার পাশাপাশি জেটি বানিয়েও দখল করা হয়েছে নদী। নদীর পাড়ই কেবল নয়, বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর ভিতরে গিয়েও তৈরি করা হয়েছে অবকাঠামো, বালাখানা। বহুতল বহু ভবন নির্মাণের মাধ্যমে প্রভাবশালীরা গিলে খাচ্ছে কর্ণফুলী।
২০১৫ সালে পরিচালিত সমীক্ষায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী দখল করে ২ হাজার ১১২টি স্থাপনা নির্মিত হয়েছে বলে উল্লেখ করে। গত কবছরে আরো বহু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে কোন কোন পয়েন্টে নদী হয়ে উঠেছে খালের মতো। ভরাট হয়ে গেছে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিং করেও নদীকে ঠিক আগের গতিতে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী কর্ণফুলী নদী ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
কর্ণফুলী নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে নদীর সীমানা নির্ধারণ, দখল, ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখতে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন ওই রিট দায়ের করে। উক্ত রিটের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদীর সীমানা নির্ধারণ করার জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়।
উক্ত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন আকারে তা আদালতকে জানানোরও নির্দেশ দেয়া হয়। এই ব্যাপারে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই সময় আরএস ও বিএস রেকর্ড অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর বর্তমান অবস্থান ও দখলদারদের চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করে।
উক্ত তালিকার প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা ৯০ দিনের মধ্যে সরানোর নির্দেশ প্রদান করেন।
আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযানে নামে জেলা প্রশাসন। টানা পাঁচ দিন অভিযান চালিয়ে নগরীর সদরঘাট থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত প্রায় চারশ’ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। দখলমুক্ত করা হয়েছিল ১০ একরের মতো জমি। পরবর্তীতে উচ্ছেদ অভিযান থেমে যায়।
আবারো দখলদারিত্ব শুরু করে প্রভাবশালীরা। এই অবস্থায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান শুরুর ঘোষণায় অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি চৌধুরী ফরিদ এবং সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান জানিয়েছেন, গতকাল নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, পাহাড় পরিবেষ্টিত নদী বিধৌত চট্টগ্রাম বাংলাদেশের লাইফ লাইন। দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ চট্টগ্রামের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অর্থনীতি সঞ্চালিত হওয়ার আসল যে জায়গাটি সেটি হচ্ছে কর্ণফুলী নদী।
কারণ চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। কর্ণফুলী নদী এবং নদীর উভয় তীর দখল হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বার্থান্বেষী মহল নামে বেনামে দখল করে কর্ণফুলীর প্রবাহমান ধারাকে সংকুচিত করে নিয়ে এসেছে।
দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এবং পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে কর্ণফুলী নদীর তীরে আগেও অভিযান চালিয়েছি। এই কোভিডের কারণে জাতীয় ভাবে সকল উচ্ছেদ কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ছিল বিধায় আমাদেরও উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন কোভিড যেহেতু নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
কর্ণফুলী নদীর তীরে বড় বড় স্থাপনা রয়েছে তাই যে সমস্ত সংস্থার সহযোগিতা নেয়া প্রয়োজন সে সকল সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে আগামী এক মাসের মধ্যে কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এই সময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনি আক্তার, এনডিসি ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. তৌহিদুর রহমান ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঢাকার বুড়িগঙ্গা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে একই সাথে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হবে।
এই ব্যাপারে প্রোগ্রাম তৈরি করা হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা বড় পরিসরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবো। তিনি কর্ণফুলী রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন।