চট্টগ্রামঃ
ওয়ান ইলেভেনের সময় কায়সার যোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেেন। অনেক বাঘা বাঘা নেতারা তখন গা ঢাকা দেয়। অনেকে সংস্কারবাদী হয়ে যান। কিন্তু আতাউর রহমান কায়সার তখন সৎসাহস নিয়ে নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
সংবাদ সম্মেলন করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ টার্ণিং পয়েণ্টে কায়সার জাতীয় ভুমিকা রেখেছিলেেন। বিভেদ নয় তিনি সহনশীল রাজনীতি করতেন। ঘুরে ফিরে স্মরণ সভায় আতাউর রহমান খান কায়সারের মহৎ গুণগুলোই আলোচনা হচ্ছিল।
অনেক অজানা তথ্য আলোচকেরা জানিয়ে দেন স্মরণ সভায়। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কেদেঁ কেঁদে বক্তব্য রাখছিলেেন। মন্ত্রী নওফেল আবেগঘণ বক্তব্য দেন। মুসলেম উদ্দিন আহমেদ সাতকানিয়ার এক সভা নিয়ে জানালেন বাবু – কায়সারের অজানা তথ্য ।
৯ অক্টোবর শনিবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সারের স্মরণ সভা নগরীর জামালখান রীমা কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর আওয়ামী লীগ যৌথভাবে আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কঠিন দুঃসময়ে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আতাউর রহমান খান কায়সার, এম এ মান্নান, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, আক্তারুজ্জামান বাবু ভাইয়েরা কোনোদিন পিছপা হননি। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার সময় যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রাম আমরা তাদের নেতৃত্বে করেছি।
রাজপথে মার খেয়েছি, আমার পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে এম এ মান্নান, আবু সালেহ ভাইয়ের নেতৃত্বে রাজপথে মিছিল করেছি। মন্ত্রী ব্যারিস্টার সুলতানের সন্ত্রাসীরা সেদিন আমাদের ওপর হামলা করেছিল।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা একদিন রাজপথে একসঙ্গে ছিলাম, সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। শুধু আমি আছি। আমারও চলে যাওয়ার কথা ছিল আগেই। কিন্তু আল্লাহ আমাকে এখনও রেখে দিয়েছেন।
নেতাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ, আসুন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করব। শেখ হাসিনার উন্নয়নের প্রতি অবিচল আস্থা রাখব, এই শপথ গ্রহণ করি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘আতাউর রহমান খান কায়সার ভাইদের মতো ভালো মানুষেরা চলে গেছেন। রাজনীতিতে আজ ভালো মানুষের বড় অভাব। শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাঁধাগ্রস্ত করতে চায় এদেশের কিছু বিরোধী দল।
অথচ তারাও সরকারে ছিল, দেশের কোনো উন্নয়ন করতে পারেনি, তারাই আজ আমাদের সমালোচক। টেলিভিশন খুললেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দেখি, শুধু সরকারের সমালোচনা করছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘মির্জা ফখরুলের জন্য আমার কষ্ট হয়। তিনি খারাপ মানুষ এটা আমি বলতে পারব না। উনার মধ্যে শিক্ষার আলো আছে। কিন্তু উনার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে শিক্ষার আলো নেই। এসএসসি পাশ করেছেন কি না সন্দেহ আছে। শিক্ষার আলো নেই বলেই তিনি জাতির পিতাকে হত্যার দিনে কেক কেটে উল্লাস করতে পারেন।
অথচ বেগম জিয়ার জন্মদিন কখনোই ১৫ আগস্ট ছিল না। ১৯৯৩ সালে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, তখন হঠাৎ তিনি ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালনের ঘোষণা দিয়ে জাতির শোকের দিন নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে শুরু করেন।’
মায়ের মতো তারেক রহমানের মধ্যেও শিক্ষার আলো নেই মন্তব্য করে হানিফ বলেন, ‘তারেক রহমানের মধ্যে যদি শিক্ষার আলো থাকতো, তাহলে আন্দোলনের নামে তিনি বাসে পেট্রোল বোমা মেরে, আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো পৈশাচিক কাজ করতে পারতেন না।
আন্দোলন-সংগ্রাম আমরাও করেছি। কিন্তু বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা- এর নাম আন্দোলন নয়। তারেক রহমানের নির্দেশে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিনশ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অসহায়- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করতে পারেন, সেই সন্ত্রাসীদের কাছে আজ মির্জা ফখরুল সাহেব অসহায়। তার মতো মানুষ পেট্রোল ঢেলে কাউকে পুড়িয়ে মারতে পারেন, এটা আমরা বিশ্বাস করি না।
কিন্তু তাকে করতে হয়েছে, তিনি করেছেন। কারণ তারেক রহমানের নির্দেশ না মানলে তার পদ থাকবে না। মির্জা ফখরুল সাহেব- আপনি সত্য কথা বলার অভ্যাস করুন। মিথ্যা আর বলবেন না। স্বীকার করুন, এই সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সত্য স্বীকারের মধ্যে লজ্জা নেই।’
হানিফ আরও বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপিকে মানুষ কেন ভোট দেবে? পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে মির্জা ফখরুল বললেন, আওয়ামী লীগ থেকে বাঁচার জন্য ভোট দেবে। বিএনপির নিজের কোনো অর্জন নেই।
ফখরুল সাহেব নিজেদের কোনো অর্জনের কথা বলতে পারেননি। এদেশের জনগণ আপনাদের আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায় না। মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ড যারা করে, তাদের মানুষ আর ক্ষমতায় আনবে না।
’আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেছেন, আমরা অনেকেই নেতা হওয়ার পরে আর তৃণমূলের দিকে ফিরে তাকাই না। স্বাভাবিক শিষ্টাচার, সৌজন্যটুকু পর্যন্ত দেখাই না। কর্মীদের সালাম নিতে আমাদের কষ্ট হয়। অথচ সুন্দরী বালিকা এসে যদি সেলফি তোলার আবদার করে, তাদের সঙ্গে সেলফি তুলি।
স্মরণ সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আরো বলেন, ‘আতাউর রহমান খান কায়সার আমাদের নেতা ছিলেন, কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন, দলের প্রতি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন।
ওয়ান ইলেভেন যখন আসে, শেখ হাসিনা যাদের নেতা বানিয়েছিলেন, দলের বিভিন্ন পদপদবী দিয়েছিলেন, তাদের অনেক রাজনৈতিক নেতা সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা করে সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন।
তখন একমাত্র কায়সার ভাই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে সুধাসদনের সামনে গিয়ে নেত্রীর পক্ষে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। নেত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে তিনি অন্য নেতাদের মতো কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি সবসময় আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।’
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘আতাউর রহমান খান কায়সার এবং উনার স্ত্রী না থাকলে আমাদের পড়ালেখা হতো কি না আমি জানি না। কারণ কায়সার আঙ্কেল এমন নেতা ছিলেন, মাঠের নেতা মহিউদ্দিনের ঘরে আগুন জ্বলছে কি না সেই খবর তিনি সবসময় রাখতেন।
উনার নিজের দুই মেয়ে যে স্কুলে পড়েছেন, আমি এবং আমার বোন টুম্পাকেও সেই বাওয়া স্কুলে তিনি ভর্তি করেছিলেন। শিশু বয়স থেকে আমি উনার সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার বাবা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী খুবই রাগী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কিন্তু কায়সার আঙ্কেলের সামনে যখন বসতেন তখন উনার কথা খুব মনযোগ দিয়ে সম্মানের সঙ্গে শুনতেন।’
প্রয়াত কায়সারের অর্থের প্রতি কোনো মোহ ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কায়সার আঙ্কেলকে দেখেছি, নেত্রীর খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় আমার বাবা জেলে ছিলেন, তখন আমাদের দুঃসময়।
অনেক বিষয়ে অনেক নেতাকে ফোন করে সহযোগিতা পাইনি। ব্যতিক্রম ছিলেন কায়সার আঙ্কেল। তিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, নেত্রীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। অর্থবিত্তের কোনো মোহ তার ছিল না। থাকলে তিনি দেশের অন্যতম সেরা ধনী হতে পারতেন।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর উনাকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়েছিল। উনি রাষ্ট্রের জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু লাইসেন্স-টেন্ডার, পারমিট খোঁজেননি, ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি। তিনি কখনো সেই পথে যাননি।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় স্মরণ সভায় আরও বক্তব্য দেন- আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে সাংসদ ওয়াসিকা আয়শা খান, কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান এবং সাংসদ নজরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান প্রমূখ।