অনলাইন সময় ডেস্কঃ
নগর উন্নয়নে সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতে সিটি মেয়রের ‘কর্তৃত্ব’ বা ‘অভিভাবকত্ব’ প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। সেক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে মেয়রের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ‘সিটি গভর্ন্যান্স’ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব আছে নগরপরিকল্পনাবিগণের।
যদিও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। এমনকি সমন্বয়ের জন্য সিটি মেয়রের কাছে সেবাদানকারী সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কার্যকর কোনো আইনি কাঠামোও তৈরি করা হয়নি। বিদ্যমান ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ এ সমন্বয়ের সুযোগ থাকলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়নি। তাই ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে সমন্বয়।
অবশ্য ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে যারা সিটি মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন তারা সেবাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিতে আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। ওই সময় সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত হতো ‘অর্ডিন্যান্স অব সিটি কর্পোরেশন-১৯৮২’র আলোকে।
আইনটির আওতায় প্রথমে সাতটি এবং পরে রেলওয়েসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোকে সিটি মেয়রের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। এমনকি ভূমি অধিগ্রহণসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারতেন তৎকালীন মেয়র। ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার আইনটি রহিত করে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত ক্ষমতাহীন হন মেয়র।
১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার সিটি মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন প্রয়াত আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ সময় তিনি মেয়রের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ‘চট্টগ্রাম সিটি গভর্নমেন্ট’ নামে একটি রূপরেখাও তৈরি করেছিলেন। দেশের কয়েকটি সিটির মেয়রদের সাথে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ ব্যবস্থার জন্য তদবিরও করেন। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি সরকার।
মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর রূপরেখায় ‘সিডিএ, বন্দর, ওয়াসা, রেলওয়ে, পানি উন্নয়নবোর্ডসহ অন্য সেবাসংস্থাগুলোর কর্ম পদ্ধতিতে সমন্বয় সৃষ্টি করে নগরবাসীর সর্বোচ্চ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার’ জন্য ‘চট্টগ্রাম সিটি গভর্নমেন্ট’ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেন। এ ব্যবস্থা চালুর পেছনে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি উদ্দেশ্যও তুলে ধরা হয় ওই রূপরেখায়।
সেখানে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ এর বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব, আয়ের উৎস, প্রশাসনিক কাঠামো তুলে ধরেন। এতে বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণসহ নয় ক্ষেত্রে সিটি গভর্নমেন্টের জন্য বিশেষ ক্ষমতার প্রস্তাব করা হয়।
সিটি গভর্নমেন্টকে ‘সমন্বিত নগর ব্যবস্থাপনাগত নীতিমালা’ উল্লেখ করে ওই রূপরেখায় বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিকল্পিত ও সমন্বিত উন্নয়নের স্বার্থে যথাযথ নাগরিক সেবা সম্প্রসারণ ও জনসাধারণের সামগ্রিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে সিটি গভর্নমেন্ট ব্যবস্থা অপরিহার্য।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর পর জোরালোভাবে এ বিষয়ে কেউ তৎপর হননি। তবে পরবর্তীতে সব মেয়রই সমন্বয়ের জন্য সিটি মেয়রের ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবি করেছেন। তারা প্রতিবেশি দেশ ভারতের মুম্বাই ও দিল্লি ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়ক সিটির মত ‘সিটি গভর্ন্যান্স’ ব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। তবে এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা তারা উপস্থাপন করেন নি।
পরবর্তীতে সমন্বয়ের দাবি ওঠার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালের ২৭ জুন ‘সিটি কর্পোরেশনের সাথে সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি দপ্তর সমূহের মধ্যে সমন্বয়’ করার জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। সেখানে সেবাসংস্থাগুলোর জবাবদিহিতার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল না। তাই কার্যকরভাবে সমন্বয় করতে পারছেন না মেয়র।
অবশ্য বর্তমানে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে জাপানের দাতা সংস্থা জাইকাসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা অর্থায়ন করছে। নগরে জাইকার অর্থায়নে সিটি গভর্ন্যান্স প্রকল্পের আওতায় পোর্ট কানেকটিং রোডের সংস্কারসহ অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চসিক।
জাইকা শর্ত দিয়েছে সেবাসংস্থার সাথে সমন্বয় করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে ‘নগর উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি’ও করা হয়েছিল। যদিও সেটা খুব কার্যকর নয়। কারণ, এখানেও ক্ষমতা নাই মেয়রের।
এছাড়া দাতা সংস্থার চাপে ‘সিটি কর্র্পোরেশন পরিচালন ব্যবস্থা (গভর্ন্যান্স) উন্নয়ন কৌশলপত্র ২০২০-২০৩০ প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ মনে করে, এ কৌশলপত্রের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনগুলো নগরায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়মতান্ত্রিকভাবে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা পাবে। বাস্তবে এ কৌশলপত্রটি প্রণীত হয়েছে বিদ্যমান ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯’ এর আলোকে। ফলে প্রতিবেশি দেশে কার্যকর সিটি গভর্ন্যান্স এর সুফল মিলছে না চট্টগ্রামে।
২০১০ সালের জুন মাসে সিটি গভর্ন্যান্স উন্নয়নে ‘ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) ১০ দফা সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল- সিটি মেয়রকে মন্ত্রীর পদ মর্যাদা প্রদান, যানবাহন নিয়ন্ত্রণসহ ট্রাফিক পুলিশের সংশ্লিষ্ট সেবা সিটি কর্পোরেশনকে প্রদান, সব সেবাদাতা সংস্থার স্থানীয় প্রধানদের সিটি কর্পোরেশনের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, জাতীয় বাজেটে সিটি কর্পোরেশনের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা। ওই সময় আইবিএফবি’র সভাপতি ছিলেন চসিকের সাবেক প্রশাসক ও মেয়র (১৯৮৮-১৯৯০) মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।
জানতে চাইলে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি মেয়র থাকাকালে প্রথম সিটি গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা চালু হয়। আমি সিটি গভর্ন্যান্স এর প্রধান ছিলাম। তখন সমস্ত সেবাসংস্থাকে সমন্বয় করতাম। সকল সেবাসংস্থার প্রধানদের তাদের কাজের বিষয়ে জবাবদিহি বাধ্যতামূলক ছিল।
সেবা ও উন্নয়ন সংস্থার প্রধানগণ চসিকের সভায় ‘অফিশিয়াল কমিশনার’ হিসেবে বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকার বিধান ছিল। সংস্থার প্রধান বা চেয়ারম্যান ছাড়া কোনো প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত থাকতে পারতেন না। তখন শহরে কি কাজ হবে, কোথায় হবে, কিভাবে হবে সবকিছুর সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা মেয়রের কাছে ছিল।
তখন একজন মন্ত্রী যত টাকার প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন তত টাকার প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা মেয়রেরও ছিল। ওই সময় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণেও সিটি কর্পোরেশনের ক্ষমতা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাস টার্মিনালের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করে সিডিএ’কে হস্তান্তর করেছিলাম।
১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার আইন করে এ ক্ষমতা বাদ দেয়। এরপর থেকে সিটি কর্পোরেশনকে অনেকটা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমি চাই বর্তমান সিটি মেয়রকেও মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হোক। চট্টগ্রামের স্বার্থে মেয়রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সিটি গভর্ন্যান্স নিয়ে আমি আলাদা কোনো প্রস্তাবনা দিই নাই। সেটা সরকার বা মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তবে সেবাসংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করার জন্য মেয়রের ক্ষমতা থাকা উচিত। সেবাসংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা থাকতে হবে। জবাবদিহিতার বিষয়টি আইনি কাঠামোর মধ্যে না এলে সমন্বয় নিশ্চিত হবে না।
আম নিজেও সমন্বয় সভা করেছি। সবাইকে ডেকেছি। কিন্তু জবাবদিহিতা না থাকায় কোনো রেজাল্ট আসছে না। তাই মেয়রের কাছে সেবাসংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা আইন করে বাধ্য করে দিতে হবে।
এখন তো সমন্বয় সভায় অনুপস্থিত থাকলেও কিছু করার থাকে না। তাই ইচ্ছে করলে আসেন, না করলে আসেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য সবাইকে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সেবা সংস্থাগুলো কোনো কাজ করার আগে মেয়রকে অবহিত করতে হবে। তবেই সমন্বয় নিশ্চিত হবে।
মেয়র বলেন, সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ হচ্ছে এবং বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। সেটা একা কোনো সংস্থার না, সবার হতে পারে। সমন্বয় থাকলে যা হতো না। যেমন আমরা একটা রাস্তায় প্যাচওয়ার্ক করলাম। কিছুদিন না যেতেই সড়কটা ওয়াসা বা অন্য কোনো সংস্থা কেটে ফেলে। সমন্বয় থাকলে সেটা হতো না। আলাপ-আলোচনা করে করলে জনভোগান্তি কম হয়।
নগরপরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছে শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশনে। তাই সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে মেয়রের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে এবং মেয়রের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অন্যথায় সমন্বয় সম্ভব না। তিনি বলেন, দিল্লি ও নিউ ইর্য়ক সিটিতে সবকিছু মেয়রের অধীনে।
অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, সিটি গভর্নমেন্টের কথা যারা বলেন তারা সিটি গভর্নমেন্ট মানে কি বুঝায় ? সিটি গভর্নমেন্টের রূপরেখা কি জানে? সিটি গভর্নমেন্টের কতটুকু করবেন তার স্পষ্ট রূপরেখা তারা আগে দিক।
শহরের সবকিছু তাদের কন্ট্রোলে থাকলে তারা কি সেটা ম্যানেজ করতে পারবেন? ক্ষমতা পেলে তো হবে না, ক্ষমতা পেলে তা ব্যবহারের সামর্থ্য আছে কীনা দেখতে হবে। সুতরাং আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সিটি গভর্নমেন্ট বলতে তারা যা বুঝায় তা হবে না।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের বর্তমানে যে ক্ষমতা আছে সে আলোকে কাজ কী ঠিকভাবে করতে পারছেন? মশক নিধন, পরিচ্ছন্নতা ও পরিকল্পনার কাজ কি ঠিকভাবে হচ্ছে? ধরেন সিটি গভর্নমেন্ট করে ওয়াসা ও বন্দর তাদের অধীনে দেয়া হলো; তখন কী তারা ম্যানেজ করতে পারবেন? তোফায়েল আহমেদ বলেন, সেবাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের কতটুকু কাজ সেটা চিহ্নিত করেই সমন্বয় করতে হবে।
তিনি বলেন, সাংগঠনিকভাবে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করার জন্য সবগুলোর কাঠামো একই করতে হবে। কাঠামোটা পার্লামেন্টরিয়াল সিস্টেমে হতে হবে। মেয়র ও চেয়ারম্যান সর্বস্ব লোকাল গভর্নমেন্ট হতে হবে।
এখানে আবার মেয়র সব নিয়ন্ত্রণ করবেন, বাকিরা কিছু না তেমন না। সেখানে মেয়র থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর মতো। অন্য দপ্তরগুলোতেও একজন করে থাকবেন। সবাইকে নিয়ে একটা কাউন্সিল হবে। সেটা মেয়র কাউন্সিল বা এঙিকিউটিভ কাউন্সিল। এটাও সিটি গভর্নমেন্টের একটা রূপ।