চট্টগ্রামঃ
চট্টগ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি এবং ধর্মীয় পীঠস্থান আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। সংস্কার না হওয়ায় কালের সাক্ষী এ মসজিদটির এখন জীর্ণদশা। খসে পড়ছে ছাদের পলেস্তারা, বেরিয়ে পড়েছে পিলার ও গার্ডারের রড। ভিতরে বাইরে এক বেহাল অবস্থা। যে কোন সময় বড় দুর্ঘটনার আশংকাও করা হচ্ছে।
সংস্কারের সুযোগ না থাকায় দোতলায় নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বড় এক তালা ঝুলিয়ে দোতলায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা কোটি কোটি টাকা এই মসজিদের উন্নয়নে দেয়ার জন্য আগ্রহী হলেও শুধুমাত্র সরকারি হওয়ার কারনেই মসজিদটি সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।
অবশ্য মসজিদটির নিয়ন্ত্রক ইসলামিক ফাউন্ডেশন সবকিছুর জন্য করোনাকালকেই দায়ী করছে। মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদটি চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি। এই মসজিদের সাথে চট্টগ্রামে মোঘলদের বিজয় কাহিনীও জড়িত রয়েছে।
১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এই আন্দরকিল্লার অন্দরে বা ভেতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় ‘আন্দরকিল্লা’। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে এখানে নির্মাণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।’
প্রায় একশ’ বছর পর ১৭৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার এই মসজিদকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৮৮৫ সালে জমিদার হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং চট্টগ্রামের ওই সময়কার ধর্মপ্রাণ মানুষদের প্রচেষ্টায় মসজিদটি পুনরুদ্ধার হয়।
১৯৮৬ সালে সরকার মসজিদটি অধিগ্রহন করে এবং এটি পরিচালনার দায়িত্ব ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে প্রদান করে।
মসজিদটির নকশার সঙ্গে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের অনেক মিল উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, দিল্লি জামে মসজিদের আদলে এই মসজিদটিও বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছিল। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মুল মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫৪ ফুট আর প্রস্থ প্রায় ২২ ফুট।
প্রতিটি দেয়াল প্রায় আড়াই গজ পুরু। মুল মসজিদের পশ্চিমের দেয়ালটি পোড়ামাটির তৈরি। বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের। মধ্যভাগে একটি বড় এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও এখন মাঝের সবচেয়ে বড়টাই ব্যবহার হচ্ছে।
উমেদ খাঁনের হাতে নির্মিত এবং গত প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের সেজদায় সিক্ত মসজিদটি চট্টগ্রামের মানুষের অন্যতম আবেগের জায়গা। বহু বছর আগ থেকে এই মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন পবিত্র মদিনা শরিফের আওলাদে রাসুল (সা.) গণ। ফলে এটি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
বিভিন্ন সময় এই মসজিদ সংস্কার হয়েছে, সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মসজিদে একই সাথে অন্তত হাজার দশেক মুসল্লি নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মসজিদটির দোতলা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ায় এটিতে এখন ছয় থেকে সাত হাজার মানুষ একই সাথে নামাজ পড়তে পারেন।
১৯৮৬ সালে সরকারি খাতে নেয়াই মসজিদটির জন্য বড় কাল হয়ে উঠে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মসজিদের মুসল্লী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই মসজিদটির অবস্থা শোচনীয়, ভয়াবহ রকমের নাজুক।
দোতলার ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। পিলার ও গার্ডারের রড বেরিয়ে পড়েছে। ছাদ থেকে মেহরাবে পানি পড়ে। বৃষ্টির সময় বালতি বসিয়ে পানি ধরতে হয়।
তিনি বলেন, এই মসজিদের জন্য চট্টগ্রামের বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান টাকা প্রদানে আগ্রহী। কুয়েত সরকার ১৪৭ কোটি টাকা প্রদান করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। আমাদের মুসল্লী পরিষদের সভাপতি হচ্ছেন এ কে খান গ্রুপের সালাহউদ্দিন কাশেম খান।
তিনি তুরস্কের অনারারী কনসাল। তুরস্কের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম এই মসজিদ পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় সব টাকা দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতায় এসব টাকার কোনটিই নেয়া সম্ভব হয়নি। সংস্কার হয়নি মসজিদ।
চট্টগ্রামে বহু বড় বড় কোম্পানি এই মসজিদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতে আগ্রহী হলেও সরকারি হওয়ায় তাও নেয়া যাচ্ছে না। সরকারি এই মসজিদটি শহরের সবচেয়ে অবহেলিত মসজিদ বলে ক্ষোভ প্রকাশে বলেন, শহরের আর কোন মসজিদেরই এমন দৈন্য দশা নেই।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিয়ন্ত্রিত না হলে মানুষ নিজেদের দান অনুদান দিয়েই মসজিদটিকে শহরের অন্যতম সমৃদ্ধ এবং নান্দনিক মসজিদে পরিণত করতে পারতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, শুধু মসজিদটির দোতলার অবকাঠামোই নয়, অজুখানা এবং ওয়াশরুমের অবস্থাও শোচনীয়। জেনারেটর ঠিকভাবে কাজ করে না। লোকবল নেই। সর্বত্র হাহাকার।
এই ব্যাপারে গতকাল ইসলামিক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ বোরহান উদ্দীন মোহাম্মদ আবু আহসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের অবস্থা বেশ খারাপ।
এটি পুননির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে। কুয়েত সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করার কথা। আট কোটি টাকার মতো ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। কিন্তু করোনার জন্য কোন কাজই করা যাচ্ছে না।
প্রকল্প গ্রহন করা হলেও টেন্ডার আহ্বান থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তিনি মসজিদের দোতলায় নামাজ আদায় পুরোপুরি বন্ধ করে রাখার কথাও স্বীকার করেন।