স্পোর্টস ডেস্কঃ
বিশ্ব ক্রিকেটের মোড়ল অস্ট্রেলিয়া মুখ থুবড়ে পড়ল বাংলাদেশে এসে। টাইগারদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত ক্যাঙ্গারুরা। সিরিজ নিয়ে নানা অযুহাতে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা অসিদের একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিল বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা।
ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার সব তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের জবাব দেওয়ার একটাই অস্ত্র ছিল বাংলাদেশের, তা হচ্ছে মাঠে পারফর্ম করা। বাংলাদেশ সেটাই করে দেখাল। সব অপমানের জবাব দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল টাইগাররা।
যে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে হোয়াইট ওয়াশের লক্ষ্য নিয়ে পা রেখেছিল এই দেশে সেই অস্ট্রেলিয়াই এখন হোয়াইট ওয়াশের সামনে দাঁড়িয়ে। পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট এবং ওয়ানডে ম্যাচ জেতা হয়েছিল কিন্তু সিরিজ জেতা হয়নি।
আর যে টি-টোয়েন্টি ফরমেটে খুব বেশি ভাল খেলেনা বাংলাদেশ সেই ফরমেটেই কিনা অস্ট্রেলিয়াকে লজ্জায় ডুবিয়ে সিরিজ জিতে নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়াকে ১০ রানে হারিয়ে টানা তিন ম্যাচে জিতে ইতিহাস গড়া সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর দায়িত্বশীল ব্যাটিং এবং পেসার মোস্তাফিজুর রহমানের বিস্ময় জাগানো বোলিং বাংলাদেশ পেল স্বপ্ন পূরণের জয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে যেন এ এক নব সূর্যোদয়। সবচাইতে কম রান করে কোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জয়, কোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এক সিরিজে টানা তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জয় সব মিলিয়ে এই দিনটি যেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সোনালী এক দিন। যে দিনটির জন্য হয়তো যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীরা।
ঢাকায় আসার আগে থেকে শুরু করে ঢাকায় পা রাখা পর্যন্ত শর্ত আর চাহিদার যেন কমতি ছিলনা। আর সে সব চাহিদা পূরণে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে বিসিবি। কিন্তু ক্রিকেটাররা যেন এসব দেখে নিজেদের ভেতরে আগুনটাকে চেপে রেখেছিল।
আর সঠিক সময়ে সে আগুনে পুড়ে ছারখার করে দিল অস্ট্রেলিয়াকে। দর্প চূর্ণ হলো অসিদের। আকাশ থেকে একেবারে মাটিতে নামিয়ে আনল টাইগাররা অসিদের। বাঘের থাবায় রক্তাক্ত ক্যাঙ্গারুরা। বাংলাদেশ রচনা করল ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস।
নিজেদের মাঠ, নিজেদের কন্ডিশনে তরুণ সব অস্ত্র নিয়ে শতভাগ সফল বাংলাদেশ। মোস্তাফিজ, শরীফুল, নাসুম, মেহেদীর মত তরুণদের সাথে সাকিবের বোলিংয়ে যে কতটা বিষ মেশানো ছিল সেটা বেশ ভালই টের পেল অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিংয়ে অভিজ্ঞদের পাশাপাশি তরুণরাও রেখেছে তাদের সাহসী ভূমিকা।
আর ফিল্ডিংয়ে কোন ধরনের ফাক রাখেনি বাংলার দামাল ছেলেরা। সব মিলিয়ে এ যেন ম্যাচের পর ম্যাচ এবং সবশেষ সিরিজ জয়ের দারুণ রেসিপি ছিল। প্রথম দুই ম্যাচে অসিদের দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পর গতকাল বুস্টার ডোজটা দিয়ে সিরিজ জিতে নিল বাংলাদেশ।
এখন টাইগারদের স্বপ্নের রাস্তাটা যেন আরো লম্বা। ইতিহাসের পাতা আরো বাড়াতে চায় টাইগার শিবির। টানা তিন ম্যাচে জয়ের পর নিশ্চয়ই বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইট ওয়াশ করা। সেটিও হয়তো পূরণ হয়ে যেতে পারে।
তবে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে গতকাল মিরপুরে ক্রিকেট বিশ্বে তা হয়তো অনেক কাল জ্বল জ্বল করে থাকবে। ১১ বঙ্গ শার্দুল করোনার এই মহামারীতে দারুণ স্বস্তি এনে দিল দেশের মানুষের জন্য। যা হয়তো কঠিন পরিস্থিতিতেও আনন্দে মাতোয়ারা করেছে ক্রিকেট প্রেমীদের।
সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে এসে প্রথমবারের মতো টসে জিতে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। কিন্তু টাইগারদের উদ্বোধনী জুটি বরাবরের মতই বিবর্ণ। দলের খাতায় ৩ রান যোগ হতেই নেই নাইম শেখ। পরের ওভারে ব্যর্থতার হ্যাটট্রিক করে বিদায় নিলেন সৌম্য সরকার।
দলের রান তখন সেই ৩। আর তিন ম্যাচে সৌম্য সরকারের সংগ্রহ ৪ রান। ৩ রানে দুই ওপেনারকে হারিয়ে চাপে পড়া বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে দায়িত্ব নেন দুই অভিজ্ঞ সাকিব এবং অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। বেশ ভালই এগুচ্ছিলেন দুজন।
কিন্তু সম্ভাবনাময় জুটিটা ভাঙে ৪৪ রানে। সাকিবকে ফিরিয়ে এ জুটি ভাঙেন এডাম জাম্পা। ১৭ বলে ৪টি চারের সাহায্যে ২৬ রান করেন সাকিব। এরপর মাহমুদ উল্লাহকে সঙ্গ দিতে আসেন আগের ম্যাচের জয়ের নায়ক আফিফ হোসেন।
কিন্তু এ ম্যাচে আফিফও পারলেননা দলের চরম সময়ে হাল ধরতে। অধিনায়কের সাথে ২৯ রান যোগ করতে পেরেছেন আফিফ। যেখানে তার অবদান ১৩ বলে ১৯। যেখানে একটি চার এবং একটি ছক্কার মার ছিল। এরপর অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ একাই লড়াই করে গেছেন অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের সামনে।
অপরপ্রান্তে আর কেউ তাকে সঙ্গ দিতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ১৯.৪ ওভারে নাথান এলিসের বলে বোল্ড হয়ে ফিরেন টাইগার অধিনায়ক। ফেরার আগে ৫৩ বলে ৪টি চারের সাহায্যে ৫২ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে আসেন মাহমুদউল্লাহ।
শেষ ওভারের শেষ তিন বলে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা নাথান এলিস। পরের দুই বলে মেহেদী হাসান এবং মোস্তাফিজুর রহমানকে আউট করে টি-টোয়েন্টি অভিষেকে হ্যাটট্রিক করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করলেন ডানহাতি এই অসি পেসার।
আর বাংলাদেশ নির্ধারিত ২০ ওভারে সংগ্রহ করতে পারে ৯ উইকেটে ১২৭ রান। সেই এলিসই ৩৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সেরা বোলার। ২টি করে উইকেট নিয়েছেন জস হ্যাজেলউড এবং এডাম জাম্পা।
১২৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিং জুটিতে পরিবর্তন আসে। বেন ম্যাকডারমটতে নিয়ে ইনিংসের সূচনা করতে নামেন অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েড। কিন্তু শুরুটা ভাল হয়নি অস্ট্রেলিয়ার।
দ্বিতীয় ওভারেই নাসুমের বলে ফিরেন ১ রান করা ওয়েড। দ্বিতীয় উইকেটে ম্যাকডারমটকে নিয়ে ভালই প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে সফল ব্যাটসম্যান মিচেল মার্শ।
দুজনে মিলে যোগ করেছিলেণ ৬৩ রান। ৪১ বলে ২টি ছক্কায় ৩৫ রান করা ম্যাকডারমটকে ফিরিয়ে এজুটি ভাঙেন সাকিব।
হ্যানরিককে বেশিক্ষণ ঠিকতে দেননি শরীফুল। এই পেসারের বলে মিডঅনে শামীমের হাতে ক্যাচ দিয়ে হ্যানরিক ফিরেন ২ রান করে। কিন্তু মিচেল মার্শকে ফেরানো যাচ্ছিলনা। তবে রানের চাকাকে টেনে ধরার চেষ্টা করছিল টাইগার বোলাররা।
অবশেষে বাধার দেওয়াল হয়ে থাকা মার্শকে ফিরিয়েছেন পেসার শরীফুল। নাইমের ক্যাচে পরিণত হয়ে ফেরার আগে ফেরার আগে ৪৭ বলে ৫১ রান করে আসেন মার্শ। আগের দুই ম্যাচে ৪৫ রানের দুটি ইনিংস খেলা মার্শ এই ম্যাচে তুলে নিলেন হাফ সেঞ্চুরি।
মার্শ ফেরার পর ম্যাচের লাগাম ঝুঁকতে থাকে বাংলাদেশের দিকে। বিশেষ করে মোস্তাফিজ, শরীফুল এবং মেহেদীর বুদ্বিদীপ্ত বোলিং বাংলাদেশকে পাইয়ে দেয় স্বপ্ন পূরণের জয়। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ২২ রান। কিন্তু মেহেদী হাসান প্রথম বলেই ছক্কা খেয়ে বসে। তবে পরের বলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন এই স্পিনার। দ্বিতীয় বলে দিয়েছেন একরান।
তৃতীয় বল থেকে কোন রানই দেননি। কিন্তু চতুর্থ বলটি করে বসে নো বল। সাথে এক রান। তবে পরের বলে ফ্রি হিটকে কাজে লাগাতে দেননি মিহিদী অস্ট্রেলিয়াকে।
শেষ দুই বলে ১২ রান দরকার পড়লেও মাত্র একরান নিতে সক্ষম হয় অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা। ফলে ১০ রানের স্বপ্ন পূরণের জয়োল্লাসে মাতে টাইগাররা।