ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী;
দর্শন মানে দেখা। সবাই দেখি কিন্তু দার্শনিক নই। সেরা মুসলিম দার্শনিক ঈমাম গাযযালী (রহঃ) বলেছেন,চোখের দোষ আছে, দূরে দেখে না, এক ইঞ্চি পরিমান কাছেও দেখে না, বাইরে দেখে ভিতরে দেখে না,জগতের অনেক কিছু দেখে কিন্তু চোখ নিজকে দেখে না,যা দেখে সত্য দেখে না (চোখকে যদি প্রশ্ন করা হয় সূর্য্যের আঁকার কত? বলবে তালা পরিমাণ। অথচ সূর্য্যের আঁকার পৃথিবী হতে তের লক্ষগুণ বড়), যদি সত্য দেখতে চাও মনের দৃষ্টি পরিস্ফুটিত করো’।
যিনি মনের চক্ষু দিয়ে দেখেন তিনিই দার্শনিক। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক।
ভারতীয় জনতা পার্টির প্রথম প্রধানমন্ত্রী কবি দার্শনিক অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন বৃটিশ-মার্কিন মিডিয়া মন্তব্য করছিলেন,’Wrong Party Right Man’ ‘ভুল দলে সঠিক মানুষ’।
আফগানিস্তানের দার্শনিক শিক্ষক মহামান্য রাষ্ট্রপতি আশরাফ গণির সাথে একান্ত বৈঠক ও দুই দুইটি আলোচনা শুনে মনে হয়েছে তিনি ভুল রাষ্ট্রে সঠিক রাষ্ট্রপতি।
তিনি ১২ ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৪৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। অর্থনীতির মেধাবী হিসেবে উন্নত শিক্ষার জন্য ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দেন। শিক্ষা জীবন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর যোগদান করেন বিশ্ব ব্যাংকের চাকুরীতে।
২৪ বছর বিদেশ কাটিয়ে আফগানিস্তানের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়’র উপাচার্য পদে যোগ দেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়টি তালেবান শাসনামলে সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছিল। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠানটি প্রানবন্ত হয়ে উঠে।
দেশটির করুন দশায় ব্যতিত হয়ে তিনি একপর্যায়ে যোগ দেন রাজনীতিতে।
তালেবান শাসনামলের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ বিচক্ষণ ভূমিকার কারণে ২০০২ সালে হামিদ কারজাই সরকার তাঁকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। নতুন মুদ্রা, কর ব্যবস্থা সংস্কার ও দাতাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন।ফলে ২০১৪ সালে তিনি বিপুল ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
দেশটির দক্ষিণে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজাকিস্তান, দক্ষিণপূর্বে চীন, পূর্ব ও উত্তরে পাকিস্তান এবং পশ্চিমে ইরান অবস্থিত। ৩৪টি প্রদেশে ভাগ করা রাষ্ট্রটিতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি জনগণ বসবাস করে। ছয় জাতি- পশতুন, তাজিক,হাজারা, উজবেক,তুর্কমেন,বালুচ, আর সাত শহরের দেশ আফগানিস্তান।
শহরগুলো হল, কাবুল, কান্দাহার, মাজার-ই-শরীফ,জালালাবাদ,হেরাত,গজনী,ফারহা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি পশতুন। অাফগান শব্দের অর্থই পশতুন। সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের মত আশরাফ গণিও পশতুভাষী। পশতুদের তিনি জনপ্রিয় নেতা।
দেশটি একটি রুক্ষ এলাকা। চারদিকে মরুভূমি আর মরুভূমি। শীতের তীব্রতা বেশী হলেও গরমের উষ্ণতা কম।প্রাচীন কাল হতে দেশটি বার বার বহিরাক্রমনের স্বীকার। সরল প্রকৃতির মানুষগুলোকে ব্যবহার করা সহজ।
পাকিস্তান ও ইরান সকল বিষয়ে দ্বিমত হলেও আফগানিস্তানকে অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া করার জন্য তারা এরকম। কারণ আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের বেলুচ প্রদেশ আর ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকার ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি আফগানদের সাথে এক ও অভিন্ন। এই দুটি প্রদেশেই চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আফগান শক্তিশালী হয়ে দুই দেশের মুক্তিকামী জনতাকে সহযোগিতা করলে ভেঙে যেতে পারে ইরান ও পাকিস্তান। এই ভয়ে দুটি দেশই দিয়ে যাচ্ছে আফগান জঙ্গিদের নিরব সহযোগিতা।
ভঙ্গুর একটি অর্থনীতির দেশে একজন অর্থনীতির শিক্ষক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত। আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সংস্কারক যার সৃজনে মততায় দক্ষতায় নৈতিকতায় শৃঙ্খলায় সহিষ্ণুতায় এবং নিয়মানুবর্তিতায় রয়েছে মেলবন্ধন তিনি রাষ্ট্রপতি আশরাফ গণি।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরীশ্রমী প্রাণবন্ত এই মানুষটির সাথে দুইদিন ব্যাপী কয়েকটি অনুষ্ঠানে কাছে থেকে দেখে বার বার ভাবছি, এই মানবিক মানুষটি কী পারবে মানবিক বিপর্যস্থ দেশ আফগানিস্তানকে পরিবর্তন করতে?
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপান ধ্বংস ও পরাজিত হওয়ার পর বিশ্ববাসী বলছিল, এই দেশ আর কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না।
তখন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ডেকে বললেন,আমরা পরাজিত। কিন্তু এই পরাজয় হতে শিক্ষা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাই। তাই জাপানের এই সফলতা। আশরাফ গণি এ ধরনের আহবান করলেও বড় ধরনের কোন সাড়া মেলেনি। কারণ এখনো জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষক পারে উন্নত জাতি গঠন করতে। তিনি ছিলেন শিক্ষক প্রশিক্ষক এখন রাষ্ট্রনায়ক। এই বিদগ্ধ পণ্ডিত রাষ্ট্রনায়কের এখনো রয়েছে জ্ঞান পিপাসা।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,দুই পিপাসার তৃপ্তি নেই। জ্ঞান ও সম্পদের পিপাসা। তিনি সম্পদ পিপাসু নন কিন্তু জ্ঞান পিপাসু।রাষ্ট্রপতি হয়েও সময় পেলে বই পড়ে জ্ঞানের জলে স্নান করেন।
দার্শনিক রাসেল বলতেন, ‘শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক’। এই অন্ধকার রাষ্ট্রটিকে আলোর পথে নিয়ে যেতে দরকার ছিল একজন শিক্ষক রাষ্ট্রনায়ক।কারণ আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের কালে বন্ধ ছিল আধুনিক সব শিক্ষার পথ। তালেবান শাসনামলে মাদ্রাসা শিক্ষা ছাড়া সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছিল নিষিদ্ধ। তালেবান সরকার পতনের পর নতুন ভাবে চালু হয় আধুনিক শিক্ষা।
জনাব আশরাফ গণির বক্তব্য হতে একটি কথা উঠে আসে। তাহলো, শিক্ষানীতি সমাজনীতি অর্থনীতি কূটনীতি নারীনীতি সমরনীতিসহ যত ধরনের নীতি আছে সব নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি।
দুনিয়ার এক নাম্বার সমস্যা হলো,’ক্রাইসিস অব লিডারশীপ’ বা নেতৃত্বের সঙ্কট। যোগ্য নেতৃত্বের কারণে একটি দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আর ব্যর্থ নেতৃত্বের কারণে ধ্বংস হয়। ভালো শিক্ষা হতেই সঠিক নেতৃত্বের জন্ম হয়।আবার ভালো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। মুরগী আগে না ডিম আগে, এটি কোন বিতর্ক নয়,কুতর্ক। তদ্রুপ নেতৃত্ব বড় না শিক্ষা? সে বিতর্কে না গিয়ে বলা যায় দুটিই প্রধান।দার্শনিক শিক্ষক হলেন রাষ্ট্রপতি। দুটির মেলবন্ধনে ভঙ্গুর দেশটিকে এগিয়ে নিতে সদা সচেষ্ট তিনি।
সত্তর দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাজধানী কাবুলে দুইদিন ব্যাপী (১৯ ও ২০ জুন,২০১৯) অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে অতিথি আলোচক হয়ে আমন্ত্রিত হই আমি আর সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলী।
সম্মেলন শেষে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে তাঁর রাজপ্রসাদে নানা প্রকার আফগান সুস্বাদু খানা আহারের মাধ্যমে নৈশভোজ আয়োজন সম্পন্ন করেন। ভোজসভায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে সুফি সাধক পীর আউলিয়া এবং খানকাহ’র মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার হয়েছে। সে ইতিহাস আমাকে মুগ্ধ করে। এ পথ অনুসরণ যোগ্য’।
‘প্রেসিডেন্সীয়াল প্যালেস”র আলোচনা হতে আত্মস্থ করতে পারি, দুনিয়াতে বাড়ছে মুসলিম, কমছে মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান। যখন সংখ্যায় মুসলমান কম ছিল তখন জ্ঞান বিজ্ঞানের সেরাটা তাঁদের হাতে ছিল। এখন মুসলমান সংখ্যায় অনেক বেশি কিন্তু জ্ঞানের কারণে পরনির্ভরশীল। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই।
রাষ্ট্রপতি আশরাফ গণি ঝুঁকি নেন৷ ঝুকি নিতে পারেন।কারণ তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। যেখানে আত্মবিশ্বাস সেখানে সাফল্য। গভীর আত্মবিশ্বাস আর সাহসের কারণে তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে পারেন।
আত্মবিশ্বাসীরাই দুনিয়াতে বিজয়ী হন। দুনিয়াতে একজন মানুষকে বিশ্বাস করা যায় সে ব্যক্তি হলো ‘আমি’। তিনি নিজকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করে বার বার ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যান। তিনি জানেন, মানব সম্পদের উপর কোনো সম্পদ নেই। সম্পদের ৮৫% মানব সম্পদ হতে আর ১৫% অন্যান্য খাত হতে আসে।
আধুনিক দুনিয়ায় উন্নতি মানে হিউম্যান ডেপল্যাপম্যান। তাই আফগানিস্তানের মানুষকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে সম্পদে পরিনত করতে না পারার কষ্ট তাঁকে মানসিক আঘাত করে।
নৈশভোজ শেষে রাষ্ট্রপতির সাথে ফটোসেশানে অংশ গ্রহণ করি। রাষ্ট্রপতি শিশুদের সাথে ফ্লোরের কার্পেটে বসে ছবি তোলার সময় আমি তাঁর পাশে বসেছিলাম।স্মৃতিগুলো মনোমুগ্ধকর।
অনুষ্ঠানে প্রবেশ ও বিদায় কালে ধর্মমন্ত্রী মৌলভী আবদুল হাকিম মুনির আমাদের অভ্যর্থনা ও বিদায় সম্ভাসন জানান।